ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক: আলোচনার অগ্রগতিতে আশায় বাংলাদেশ


মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা পাল্টা শুল্ক নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চূড়ান্ত দফায় আলোচনা হয়েছে গত রাতে। তবে সেই আলোচনায় বসার আগেই কিছুটা স্বস্তির আবহ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের মধ্যে। বৈঠকের প্রথম ও দ্বিতীয় দিনেই আলোচনায় দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে জানিয়ে তারা বলছে, দুই দেশের মতপার্থক্য অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। তাই শুল্ক নিয়ে একটি বাস্তবধর্মী সমঝোতায় পৌঁছানোর আশা করছেন বাংলাদেশ পক্ষের আলোচকেরা।
প্রথম দিনের বৈঠক শেষে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে জানান, বাংলাদেশের অবস্থান ও পরিকল্পনা দেখে সন্তুষ্ট মার্কিন পক্ষ। আর আলোচনার দ্বিতীয় দিন শেষে প্রতিনিধিদলের একাধিক সদস্য জানান, এখন শুধু শুল্ক কমা নিশ্চিত নয়, বরং তা হবে ‘সন্তোষজনক মাত্রায়’। একজন অংশগ্রহণকারী বলেন, ‘দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা যেখানে শেষ হয়েছিল দ্বিধায়, সেখানে তৃতীয় ধাপ এগোচ্ছে পরিষ্কার সংকেত দিয়ে। আমাদের প্রস্তাব গুরুত্ব পেয়েছে।’
৮ জুলাই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঠানো ট্রাম্পের চিঠিতে সরাসরি হুঁশিয়ারি ছিল, যদি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ভারসাম্যের স্পষ্ট রূপরেখা দিতে না পারে, তবে রপ্তানি পণ্যের ওপর আরোপিত বর্তমান ১৫ শতাংশ গড় শুল্কের সঙ্গে যোগ হবে আরও ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ৫১ শতাংশ শুল্কের বোঝা নিয়ে মার্কিন বাজারে ঢুকতে হবে বাংলাদেশি পণ্যকে।
এই অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়ে মার্কিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দুই দফায় বৈঠকে বসেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। তবে ওই দুই পর্বে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু আঁচ করা যাচ্ছিল না। এই অবস্থায় শুরু হয় তৃতীয় দফার আলোচনা। শেষ পর্বের অর্থাৎ চূড়ান্ত দিন গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত ওয়াশিংটনে ইউএসটিআর কার্যালয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মো. মাহবুবুর রহমান এবং অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাওসার চৌধুরী। মার্কিন পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন ইউএসটিআরের সহকারী ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ ব্রেন্ডন লিঞ্চ।
বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, আলোচনার এ পর্যায়ে যদি দুই পক্ষ সব অ্যাজেন্ডায় একমত হতে পারে, তাহলে একটি ‘রেসিপ্রোকাল ট্রেড ফ্রেমওয়ার্ক’ চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করা হবে। সেই খসড়াকে ভিত্তি করেই ইউএসটিআর একটি সুপারিশপত্র তৈরি করে তা পাঠাবে হোয়াইট হাউসে। এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প—কতটা ছাড় দেবেন, সেটি নির্ভর করবে সম্পূর্ণ তাঁর সদিচ্ছার ওপর।
বাংলাদেশের প্রস্তাব ছিল, যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া পণ্যের শুল্কহার যেন ১০-২০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। এর পেছনে আন্তর্জাতিক উদাহরণও তুলে ধরা হয়; যেখানে ভিয়েতনাম ২০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন ১৯, জাপান ও ইইউ ১৫ এবং যুক্তরাজ্য ১০ শতাংশ হারে সমঝোতা পেয়েছে। বাংলাদেশও একটি যৌক্তিক ও প্রতিযোগিতামূলক হারে পৌঁছাতে চায়।
তবে আলোচনায় শুধু বাণিজ্যিক হিসাব নয়, থাকছে ভূরাজনৈতিক হিসাবও। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা, দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নীতির দিকনির্দেশনা, এসবই এসেছে আলোচনার পরিধিতে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই দিকগুলো ঘিরেই কাঠামোগত আলোচনা শুরু হয়েছে। ওয়াশিংটন চায়, বাংলাদেশ একটি নির্দিষ্ট কৌশলগত নীতিপথ অনুসরণ করুক।
যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রত্যাশাকে বাংলাদেশ মোকাবিলা করছে বাণিজ্য উন্নয়নের কৌশলগত ফর্মুলা দিয়ে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই বড় পরিসরে মার্কিন পণ্য আমদানির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকারি ও বেসরকারি দুই পর্যায়ে। এই পরিকল্পনার আওতায় এক বছরে দেড় বিলিয়ন ডলারের গম, ডাল, এলএনজি এবং আরও কিছু পণ্য কেনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭ লাখ টন গম কেনার চুক্তি ইতিমধ্যে চূড়ান্ত, আর ২ দশমিক ২০ লাখ টনের প্রস্তাব অনুমোদনের অপেক্ষায়। এ ছাড়া ২৫টি বোয়িং বিমান কেনার জন্য আগাম অর্ডার দেওয়া হয়েছে।
বেসরকারি খাতও পিছিয়ে নেই—বিটিএমএ, টিকে গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপের প্রতিনিধিরা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন, সম্ভাব্য বড় অর্ডার ও চুক্তি নিয়ে মার্কিন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত রয়েছেন। বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছেন, সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পণ্য আমদানি বাড়বে।
এই অতিরিক্ত আমদানির অঙ্গীকারই মূলত যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কসংশ্লিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নরম করতে বড় ভূমিকা রাখছে। আলোচনাসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আমরা যে ধরনের প্রস্তাব আর প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, তা মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ফেলেছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা—ট্রাম্প এই সমঝোতা কতটা মূল্যায়ন করেন।’