রিকশাচালককে জুতাপেটা করে বরখাস্ত সেই সমাজসেবা কর্মকর্তাকে ক্ষমা


ভাড়া কম দেওয়া নিয়ে রিকশাচালককে জুতাপেটা করা আলোচিত (বরখাস্ত) সমাজসেবা কর্মকর্তা জাহিদ হাসান রাসেল নিজেকে শুধরে নিয়েছেন। এ জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ। শুধু তাই-ই নয়, বরখাস্ত থাকার সময়টি কর্মকাল হিসেবে গণ্য করে তাঁকে বগুড়ার দুপচাচিয়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে।
গত রোববার (২৭ জুলাই) সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপসচিব মোহাম্মদ আবদুল হামিদ মিয়া স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় এবং আজ বুধবার সেখানে যোগ দিতে বলা হয়।
এর আগে তিনি রাজশাহীর পবা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত ২ ফেব্রুয়ারি তিনি এক রিকশাচালককে নির্দয়ভাবে পেটান। মুহূর্তে এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
জাহিদ হাসানের স্ত্রী একজন বিচারক। ঘটনাটি ঘটেছিল রাজশাহীর জাজেস কোয়ার্টারের সামনেই। ভাড়া ঠিক করে না উঠে কম টাকা দেওয়ায় রিকশাচালক তাকে ‘লাট সাহেব’ বলেছিলেন। এতেই মেজাজ হারিয়ে ওই রিকশাচালককে জুতাপেটা করেন তিনি। এতেও তাঁর ক্ষোভ মেটেনি। গাড়ির ব্যাক ডালা থেকে লাঠি বের করে তিনি রিকশাচালককে পেটান।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘লাট সাহেব বলায় রিকশাচালককে জুতাপেটা করলেন সমাজসেবা কর্মকর্তা’ শিরোনামে আজকের পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হয়। পরে ৩ ফেব্রুয়ারি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন-৫ (প্রশাসন ও শৃঙ্খলা) শাখার প্রজ্ঞাপনে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ঘটনা তদন্তে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) শহীদুল ইসলামকে তদন্তকারী কর্মকর্তাও নিযুক্ত করা হয়।
তদন্ত শেষে শহীদুল ইসলাম সমাজসেবা অধিদপ্তরে প্রতিবেদন দাখিল করেন। এর ভিত্তিতে ২২ জুলাই সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. মহিউদ্দিনের স্বাক্ষর করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, জাহিদ হাসান তাঁর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য অনুতপ্ত ও ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। ভবিষ্যতে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা তাঁর দ্বারা আর হবে না মর্মে লিখিত অঙ্গীকারনামাও দিয়েছেন। রিকশাচালকের সঙ্গে ‘ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির কারণে’ তিনি ক্ষমাও প্রার্থনা করেন।
জাহিদ হাসান তাঁর লিখিত বক্তব্যে বলেছেন, ‘ঘটনাটি তাঁর জীবনকে বদলে দিয়েছে। ওই ঘটনার পর থেকে তিনি নিজেকে শুধরে নিয়েছেন। এ শোধরানোর মধ্য দিয়ে তিনি বাকি জীবন অতিবাহিত করতে পারবেন।’
তাই তাঁর সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা সমীচীন মর্মে মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এ জন্য সাময়িক বরখাস্তের আগের আদেশ প্রত্যাহার করা হলো এবং তাঁর সাময়িক বরখাস্তকাল কর্মকাল হিসেবে গণ্য করা হলো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাহিদ হাসান পবায় থাকাকালে নানা বিতর্কিত ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। তাঁর দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত বছরের ৩১ মার্চ উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা শিমুল বিল্লাহ সুলতানা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে জাহিদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন।
শিমুল সুলতানা জানান, জাহিদ প্রায়ই অশোভন আচরণ করেন। উপজেলা পরিষদ চত্বরে তিনি সবার সামনে অকথ্য ও অশ্রাব্য ভাষায় অশালীন আচরণ করেন।
এর আগে দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ ২০২৩ সালের ১৬ মে পবা উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী সমাজসেবা কর্মকর্তা শারমিন আফরোজ রাজশাহী জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের তৎকালীন উপপরিচালক হাসিনা মমতাজের কাছে জাহিদ হাসানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অভিযোগের তদন্তও হয়নি।
জাহিদের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার শরীফবাড়ি গ্রামে। সেখানে তিনি ফাতেমা ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠন করেছেন। এই সংগঠনের জন্য তিনি নিয়ম ভেঙে পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভা থেকে সরকারি ডাস্টবিন নিয়ে যান।
পৌরসভার ডাস্টবিন বিতরণ সংক্রান্ত কমিটির সভাপতি ছিলেন জাহিদ হাসান। তিনি অফিসে ‘বিচারক’ লেখা প্রাইভেটকারে চড়ে যাওয়া-আসা করেন। অফিস সহকারী সোহাগ আলীকে দিয়ে গাড়ি পাহারা দেওয়াতেন তিনি।
এসব নিয়ে ৬ মার্চ আজকের পত্রিকায় ‘সমাজসেবার বদলে নিজের সেবা’ শিরোনামে একটি সংবাদ ছাপা হয়। তবে এসব নিয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। রিকশাচালককে পিটিয়েও পার পেয়ে গেলেন এই কর্মকর্তা।
জাহিদ হাসান বগুড়ার দুপচাচিয়া উপজেলায় যোগ দিয়েছেন কি না তা জানতে তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। সাংবাদিক পরিচয় দিলেই তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিভাগীয় সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক সৈয়দ মোস্তাক হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জাহিদ হাসানের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের বিষয়টি তিনি জানেন। তবে তিনি দুপচাচিয়ায় যোগ দিয়েছেন কি না তা জানেন না।’