এক গুপ্তহত্যা যেভাবে উসকে দেয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ


আজ থেকে ১১১ বছর আগের আজকের এই দিনে (২৮ জুলাই) শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তবে, এত বড় এক যুদ্ধের সূত্রপাত ঠিক এক মাস আগে অর্থাৎ ২৮ জুন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী আর্চ ডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের বসনিয়া সফরকে কেন্দ্র করে।
১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই সকালে ছাদখোলা বিলাসবহুল গাড়িতে করে সস্ত্রীক বসনিয়া প্রবেশ করেন ফার্দিনান্দ। সারায়েভোর সড়কে গাড়ি পৌঁছালে তাঁদের দেখতে সড়কের দুপাশে উপচে পড়ে মানুষের ভিড়। চারদিকে উৎসবমুখর পরিবেশ। সড়কগুলোও সাজানো হয়েছিল বিশেষভাবে। হঠাৎ পরপর দুটির গুলির শব্দে এলোমেলো হয়ে যায় সবকিছু। গ্যাভরিলো প্রিনসিপ নামের এক সার্বীয় জাতীয়তাবাদী খুব কাছ থেকে গুলি ছোড়েন। গলায় গুলিবিদ্ধ হন ফার্দিনান্দ আর তাঁর স্ত্রীর পেটে গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ ফার্দিনান্দ মৃত্যুমুখে তাঁর স্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘সোফি, সোফি, তুমি মরো না। আমাদের সন্তানদের জন্য তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে!’
তবে, সোফি তাঁর স্বামীর শেষ কথা রাখতে পারেননি। কিছুক্ষণের ব্যবধানে মারা যান দুজনই।
বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার ওপর অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির শাসনের অবসান ঘটাতে সংগ্রাম করছিলেন সার্বীয় জাতীয়তাবাদীরা। বসনিয়া–হার্জেগোভিনার সামরিক গভর্নর অস্কার পোতিওরেকের অনুরোধে আর্চ ডিউক ফার্দিনান্দের সারায়েভো সফরে বসনীয় ও সার্ব জাতীয়তাবাদীরা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাঁরা এ সফরকে সাম্রাজ্যবাদী দখলের প্রতীক হিসেবে দেখেছিলেন। তাই ফার্দিনান্দকে হত্যা করে মূলত স্বাধীনতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল জাতীয়তাবাদীরা। কিন্তু তাঁরা হয়তো ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি এই একটি কাজেই গোটা বিশ্ব অশান্ত হয়ে পড়বে। শুরু হবে বিশ্বযুদ্ধ!
ফার্দিনান্দ হত্যাকাণ্ডের জেরেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল—সরলভাবে এমনটা বলা কঠিন; বরং সে সময়ে বিভিন্ন সম্রাটের সাম্রাজ্য বিস্তারের লোভ এ যুদ্ধের সূচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর বহু আগে থেকেই ইউরোপজুড়ে উত্তেজনা দানা বাঁধছিল, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের অশান্ত বলকান অঞ্চলে।
অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এই হত্যাকাণ্ডের দায় সরাসরি চাপায় সার্বিয়ার ওপর। বিশ্লেষকদের মতে, সার্ব জাতীয়তাবাদের উত্থান চিরতরে দমন করাই ছিল অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির লক্ষ্য। আর এ ঘটনার পর সেই লক্ষ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দুই দেশ। সার্বিয়ার পাশে দাঁড়ায় রাশিয়া। বিপরীতে, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি জার্মানির গোপন সমর্থন নিশ্চিত করে। এর ফলে ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলোর মধ্যে পূর্বে গঠিত জোট ও শান্তিচুক্তিগুলো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়।
সার্বিয়ার বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির যুদ্ধ ঘোষণার পর দ্রুত প্রতিক্রিয়া আসে। রাশিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য এবং বেলজিয়াম যুক্ত হয় সংঘাতে। ফলে যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে সার্বিয়ার পাশে থাকা মিত্রশক্তি (রাশিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য) ও অক্ষ শক্তি (জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, পরবর্তীতে অটোমান সাম্রাজ্য)। বিশেষ করে যুক্তরাজ্য সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে জার্মানির বেলজিয়াম আক্রমণের পর। বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের সঙ্গে পূর্বের চুক্তির ভিত্তিতে যুক্তরাজ্য এই সিদ্ধান্ত নেয়।
এই পরাশক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিটি দেশ (যুক্তরাজ্য, জার্মানি, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি) উপনিবেশ বিস্তারে ব্যস্ত ছিল। তারা নিজেদের সাম্রাজ্য রক্ষায় উদ্বিগ্ন ছিল এবং অন্য কোনো শক্তি নতুন ভূখণ্ড দখল করলে তা নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখত। ১৯১৪ সালের গ্রীষ্মে যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন বহু মানুষ ভেবেছিল এই যুদ্ধ বড়দিনের আগেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু খুব অল্প সময়েই তাদের সেই ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়। মেশিনগান, ট্যাংক, কামান, যুদ্ধবিমান, এমনকি রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্রকে পরিণত করে এক ভয়ানক নরকে।
যুদ্ধের প্রথমদিকে জার্মানি দ্রুত সাফল্য পেতে থাকে। বেলজিয়াম ও উত্তর ফ্রান্স দখল করে তারা এগিয়ে যায়। তবে সেপ্টেম্বর মাসে ফ্রান্সের মার্নে নদীর তীরে ‘প্রথম মার্নের যুদ্ধে’ মিত্রশক্তির প্রতিরোধে তাদের অগ্রগতি থেমে যায়। এই লড়াই যুদ্ধের ধরন পাল্টে দেয়। ইতিহাস বিখ্যাত ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে শুরু হয় এক দীর্ঘ, নিষ্ঠুর এবং অচলাবস্থার মতো সংঘাত। ১৯১৬ সালের ভারদাঁ ও সোমের যুদ্ধগুলোতে লাখ লাখ সৈন্য হতাহত হলেও, ফ্রন্টলাইনের অবস্থানে খুব সামান্যই পরিবর্তন আসে।
চার বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ১৯১৮ সালের নভেম্বরে অবসান ঘটে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ এই যুদ্ধের। ৩০ টিরও বেশি দেশের সম্পৃক্ততায় সংঘটিত এই যুদ্ধ শুধু ইউরোপ নয়, প্রভাব ফেলেছিল পুরো বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোয়।