শিরোনাম
‘প্রথমেই দেখি এক শিশুর ছিন্নভিন্ন দেহ’, এক শিক্ষার্থীর বয়ানে মাইলস্টোনের বিভীষিকাড. ইউনূসের মানহানি মামলা খারিজের রায় বহালদেশে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর মুনাফায় ধসজোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে কুতুবদিয়ার বিভিন্ন এলাকাঢাকার মাদ্রাসা-ই-আলিয়ায় অস্থায়ী আদালত অপসারণ ও হলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদনাগরিক সেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে পাথরঘাটা পৌরসভা ঘেরাওপ্রথম শতভাগ কার্যকর এইচআইভির ওষুধ, অনুমোদন দিল যুক্তরাষ্ট্রকুপিয়ে স্বামীকে হত্যা, ভারতে পালানোর চেষ্টায় ছিলেন পাপিয়াএশিয়া কাপে আছেন সাকিবও!গাজায় ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের অনুমতি ইসরায়েলের, আকাশপথেও ফেলা হচ্ছে সামগ্রী

দ্য গার্ডিয়ানের নিবন্ধ /দুই বন্ধুর বিচ্ছেদই কি আগুন জ্বালাল থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্তে

দ্য গার্ডিয়ানের নিবন্ধ /দুই বন্ধুর বিচ্ছেদই কি আগুন জ্বালাল থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্তে

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যকার শত বছরের পুরোনো সীমান্তবিরোধ আবারও রূপ নিয়েছে সংঘাতে। প্রাচীন হিন্দু মন্দির এলাকা, উপনিবেশ আমলের মানচিত্র এবং দীর্ঘদিনের অস্পষ্ট সীমারেখা—এসব ইস্যু ঘিরে দুই দেশের উত্তেজনা নতুন কিছু নয়। তবে এবার এই সংঘর্ষের পেছনে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার এমন এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে, যা গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতিক ভারসাম্যকেই প্রভাবিত করতে পারে।

গত বৃহস্পতিবার নতুন করে যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, সেটি কেবল সীমান্ত রক্ষীদের গোলাগুলির ঘটনা নয়; এটি দুই প্রভাবশালী সাবেক রাষ্ট্রনেতার—কাম্বোডিয়ার হুন সেন এবং থাইল্যান্ডের থাকসিন সিনাওয়াত্রার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের একটি বহিঃপ্রকাশ বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত।

বহু বছর ধরে তারা ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, একে অপরকে ‘ভাই’ বলে ডাকতেন। থাই সেনাবাহিনীর সঙ্গে থাকসিন ক্ষমতার লড়াইয়ে হুন সেন বছরের পর বছর থাকসিন পরিবারকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থাকসিন ও তাঁর বোন ইংলাক হুন সেনের বাসভবনে আশ্রয় পান। এমনকি হুন সেন তাঁকে কম্বোডিয়ার অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগও দিয়েছিলেন। থাকসিন নিয়মিত কম্বোডিয়াসফরে যেতেন। থাকসিন স্বেচ্ছানির্বাসন শেষে ফেরার পর প্রথম বিদেশি নেতা হিসেবে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন হুন সেন।

অতীতের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আজ ইতিহাস। গত কয়েক মাসে এই সম্পর্ক নাটকীয়ভাবে ভেঙে পড়েছে। দ্বন্দ্বের প্রকৃত কারণ পরিষ্কার নয়। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই ব্যক্তিগত বিরোধ এখন দুই দেশের সীমান্তে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পেছনে নতুন এক বিস্ফোরক মাত্রা যোগ করেছে। বর্তমানে দুজনের কেউই সরাসরি ক্ষমতায় না থাকলেও উভয়ই এখনও যথেষ্ট প্রভাবশালী। হুন সেন প্রায় ৪০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০২৩ সালে ছেলের হাতে ক্ষমতা তুলে দেন। অন্যদিকে থাকসিনের কন্যা পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা গত বছর থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হন, যদিও বর্তমানে তিনি বরখাস্ত।

সম্পর্কের ভাঙন এতটাই তীব্র যে, হুন সেন নিজেই সাবেক থাই প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্নের সঙ্গে এক ফোনালাপ সম্প্রতি ফাঁস করে দিয়েছেন। সেই ফোনালাপে ‘চাচা’ সম্বোধনের মধুরতা ছিল, কিন্তু শীর্ষস্থানীয় থাই শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাকে ঘিরে কিছু অবমাননাকর মন্তব্যও। এই ফোনালাপ প্রকাশ্যে আসতেই থাইল্যান্ডে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পেতংতার্নকে বরখাস্ত করে তদন্ত শুরু করে দেশটির সাংবিধানিক আদালত।

এই ঘটনা নতুন করে প্রশ্ন তোলে—কেন এমন করলেন হুন সেন? কেন এই সম্পর্কচ্ছেদ? কেন হঠাৎ হুন সেন তাঁর পুরোনো বন্ধুর বিপক্ষে গেলেন, তা স্পষ্ট নয়। তিনি থাকসিনকে ‘বিশ্বাসভঙ্গকারী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং সিনাওয়াত্রা পরিবার নিয়ে আরও তথ্য ফাঁসের হুমকি দিয়েছেন। থাকসিন বলেছেন, ‘আমি কল্পনাও করিনি, এত ঘনিষ্ঠ কেউ এমন আচরণ করতে পারে।’ এরপরই তাঁদের বন্ধুত্বের অবসান ঘোষণা করেন।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ভূ-রাজনৈতিক ও অপরাধজগতের কিছু অপ্রকাশিত বাস্তবতা এই দ্বন্দ্বের পেছনে সক্রিয়। অনেকের মতে, থাই কর্তৃপক্ষ ‘স্ক্যাম কম্পাউন্ড’ বন্ধে উদ্যোগ নেওয়াতেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন হুন সেন। এসব জায়গায় বিদেশি নাগরিকদের আটকে রেখে সাইবার প্রতারণা চালানো হয়। এই ধরনের অপরাধ গত কয়েক বছরে বিশেষ করে কম্বোডিয়াতে ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। থাইল্যান্ড এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে গেলে কম্বোডিয়ার শাসকগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে চাপ পড়ে। অনেকেই মনে করেন, এখানেই শুরু হুন সেনের রাগ।

সিঙ্গাপুরভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইএসইএএস-ইউসুফ ইসহাক ইনস্টিটিউটের সহযোগী গবেষক তিতা সাংলি বলেন, ‘থাইল্যান্ডে জনপ্রিয় মত হলো—হুন সেন ও থাকসিনের মধ্যে কিছু গোপন লেনদেন হয়েছিল, যেটি প্রত্যাশা অনুযায়ী না হওয়ায় তা এখন জাতীয় স্বার্থকেও ছাপিয়ে গেছে।’ যাই হোক, হুন সেন সফলভাবে থাকসিনের রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল করে দিয়েছেন। থাই সামরিক বাহিনী ও শিনাওয়াত্রা পরিবারে বিভাজন তৈরি করেছেন, যার ফলে থাইল্যান্ডে একধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে।

এদিকে, হুন সেন সরাসরি ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর ছেলেকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে রেখে নিজে রয়েছেন দৃশ্যপটের নেপথ্যে। দেশের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছেন, বিরোধী কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করে রেখেছেন দীর্ঘদিন ধরেই। কাজেই আন্তর্জাতিক মহলের চিন্তার বিষয় হলো—যদি হুন সেন সীমান্তে সংঘর্ষকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন, তবে সে সংঘর্ষ দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তিতা সাংলির মতে, ‘যখন তিনি সামরিক বা রাজনৈতিকভাবে কঠোর অবস্থান নেন, এর তাৎক্ষণিক এবং গুরুতর প্রভাব পড়ে।’

বৃহস্পতিবার রাতে থাকসিন জানান, তিনি সীমান্ত বিরোধে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেওয়া দেশগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞ। তবে আপাতত অপেক্ষা করতে চান। তিনি বলেন, ‘আমাদের থাই সেনাবাহিনীকে সুযোগ দিতে হবে, প্রথমে এই চতুর হুন সেনকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে।’ তবে থাকসিন সিনাওয়াত্রার অবস্থান এখন বেশ নাজুক। নিজে দীর্ঘদিন বিদেশে নির্বাসনে থেকে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। তাঁর মেয়ে প্রধানমন্ত্রী হলেও তাঁর পরিবারকে ঘিরে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক বরাবরই টানাপড়েনপূর্ণ। এবার হুন সেনের ফাঁস করা ফোনালাপ ও অভিযোগে যেন আরও একধাপ পিছিয়ে গেলেন থাকসিন। সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব নিরসনের আগেই পারিবারিক দুর্নীতির অভিযোগ ও জাতীয় স্বার্থের প্রতি অবহেলার অভিযোগ তাঁকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে ফেলেছে।

এই অবস্থায় হুন সেনের উদ্দেশে হুমকিস্বরূপ বক্তব্য দিলেও থাকসিনের পক্ষে সরাসরি কূটনৈতিক কিংবা সামরিক জবাব দেওয়া এখন প্রায় অসম্ভব। তাই দেখা যাচ্ছে, সীমান্তে সংঘর্ষ বাড়লেও তার দায় সেনাবাহিনীর কাঁধেই তুলে দিচ্ছেন তিনি। এমন পরিস্থিতিতে গত সপ্তাহে থাইল্যান্ড সরকার কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করে, কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে এবং নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে আনে।

এ ঘটনার সামাজিক প্রতিক্রিয়াও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সীমান্তে উদ্বাস্তু মানুষের কাছে গিয়ে থাকসিন যখন সহমর্মিতা জানাতে যান, তখনই এক নারী জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি তো হুন সেনের বন্ধু, তাই না? তাহলে ওরা আমাদের ওপর গুলি চালাচ্ছে কেন?’ এই এক প্রশ্নেই ফুটে ওঠে রাজনৈতিক সম্পর্কের ছায়া সাধারণ মানুষের জীবনে কীভাবে আঘাত হানে। অবশ্য অঞ্চলবিশেষের ভূরাজনৈতিক ইতিহাসে এমন ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রভাব নতুন কিছু নয়। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে, যেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য শক্তির প্রভাব প্রতিযোগিতা করছে, সেখানে এই সংকট আরও গভীর উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে।

জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক পাভিন চাচাভালপংপুন বলেন, ‘সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনো দেশই এক ইঞ্চি জমিও ছাড়তে চায় না। কিন্তু যখন সেই ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা জুড়ে যায়, তখন তা আরও অনিশ্চয়তা তৈরি করে।’

এই সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার প্রস্তাব এলেও দুই দেশের বর্তমান অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা এতটাই জটিল যে দ্রুত সমাধানের আশা করা কঠিন। সীমান্তে গোলাগুলি, কূটনৈতিক টানাপড়েন আর আস্থাহীনতার আবহে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াএখন এক বিপজ্জনক দ্বন্দ্বের মুখোমুখি—যার পেছনে রাজনীতি যেমন আছে, তেমনি আছে দুই বন্ধুর ভাঙা সম্পর্কের বিষাদ।

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button