এক বছরেই আমদানি বাড়াবে দেড় বিলিয়ন


যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস ও রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ এক বছরের মধ্যে মার্কিন বাজার থেকে অতিরিক্ত দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানির পরিকল্পনা নিয়েছে। বাণিজ্যিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সরকার একদিকে যেমন বৃহৎ পরিসরে সরকারি আমদানির অর্ডার বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে বেসরকারি খাতকে বিশেষভাবে যুক্ত করছে এই মহাপরিকল্পনায়। ঢাকার হিসাবে, এই উদ্যোগের ফলে দুই দেশের ৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি ৩ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত কমে আসবে।
এই বার্তা পৌঁছে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তর ইউএসটিআরের সঙ্গে চূড়ান্ত শুল্ক সংলাপে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল। আজ মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন বাণিজ্যসচিব মো. মাহবুবুর রহমান, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব এবং অতিরিক্ত সচিব ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
এই সফরে বাংলাদেশ শুধু মৌখিক প্রতিশ্রুতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না, প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রকে দেড় বিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত আমদানির লিখিত অঙ্গীকারপত্র দেবে। প্রথম বছরে এই অর্ডার বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে, যা ভবিষ্যতে আরও বাড়ানো হতে পারে। সরকারি পর্যায়ের পাশাপাশি অংশ নিচ্ছে বড় বড় বেসরকারি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানও।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা ইউএসটিআরকে স্পষ্ট করে জানাচ্ছি, যে হারে আমদানির পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাতে ৩ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ঘাটতি কমে আসবে। প্রথম ধাপে এক বছরের মধ্যেই দেড় বিলিয়ন ডলারের বাড়তি আমদানি নিশ্চিত করা হবে।’
এই পরিকল্পনার আওতায় ইতিমধ্যে ৭ লাখ টন গম আমদানির চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। একইভাবে সয়াবিন, তেলবীজ ও তুলার আমদানি কয়েক গুণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই খাতগুলোর ব্যবসায়ীরাও প্রতিনিধি হিসেবে ওয়াশিংটনে রয়েছেন, যাঁরা সরাসরি আমদানি কার্যাদেশ চূড়ান্ত করবেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, আগেই মার্কিন বাজারে আগ্রহী আমদানিকারকদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে অগ্রাধিকার পেয়েছে অভিজ্ঞ করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও কৃষিভিত্তিক আমদানিকারকেরা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের এই কৌশলগত উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে টিকে থাকার এক বাস্তবসম্মত রূপরেখা। শুধু রপ্তানি বৃদ্ধির কথা বললে পরিস্থিতির উন্নতি হতো না; তাই ঘাটতি কমাতে আমদানিতে আন্তরিকতা দেখানো এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
শুধু রপ্তানির ওপর জোর না দিয়ে আমদানিতে আন্তরিকতা দেখানো, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য একটি বাস্তববাদী কৌশল উল্লেখ করে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাণিজ্য ঘাটতি যেখানে রেসিপ্রোকাল শুল্ক নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখছে, সেখানে আমদানি না বাড়িয়ে বাংলাদেশর সামনে তেমন কোনো বিকল্প নেই। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এই সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী ও কার্যকর।’
আব্দুর রাজ্জাকের মতে, ‘এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে শুধু বাড়তি শুল্কের চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না, বরং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে একটি টেকসই নীতিগত অবস্থানও তৈরি হবে।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানায়, সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। নতুন পরিকল্পনায় এই অঙ্কের সঙ্গে দেড় বিলিয়ন ডলার যুক্ত হবে। তুলা, তেলবীজ, সয়াবিন, গম ও কৃষিপণ্য; এই পাঁচটি খাত থাকবে কেন্দ্রবিন্দুতে। পাশাপাশি রাসায়নিক কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতি, দুর্লভ ওষুধ ও সামরিক সরঞ্জামের আমদানিও বাড়ানো হবে। আর ২৫টি বোয়িং উড়োজাহাজ কেনার প্রক্রিয়া শেষ হলে ঘাটতি প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসতে পারে।
বৈঠকের শেষ দিনে নির্দিষ্ট পণ্যভিত্তিক চুক্তির পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও পৃথক আলোচনা হবে। ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে শুল্ক কমানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইতিবাচক কোনো বার্তা পাওয়া যেতে পারে।
সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ভিয়েতনামের বাণিজ্য ঘাটতি ১২৩ বিলিয়ন ডলার হলেও তারা ২০ শতাংশ ট্যারিফ চুক্তি করেছে। আমাদের ঘাটতি মাত্র ৬ বিলিয়ন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের ট্যারিফ রেট ভিয়েতনামের তুলনায় আরও কম হবে, এটিই প্রত্যাশা।’