বাইরের ২০ কাজের চাপে শিক্ষক


শুধু পাঠদান নয়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যেন অনেক কাজের কাজি। ভোট গ্রহণ, ভোটার তালিকা, শুমারি, জরিপ, টিকাদান, কৃমিনাশক ওষুধ ও ভিটামিন ক্যাপসুল খাওয়ানো, টিসিবির চাল বিতরণ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানসহ বারোয়ারি অন্তত ২০ ধরনের কাজ করতে হচ্ছে তাঁদের। সরকারি এসব কাজে বছরে ব্যস্ত থাকছেন কমপক্ষে ৬০ কর্মদিবস।
শিক্ষকেরা বলছেন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে পাঠদানের বাইরে এসব কাজ তাঁরা করছেন। এসব কাজের চাপে সিলেবাস শেষ করা যায় না। এতে শিখন ঘাটতি থেকে যায় শিক্ষার্থীদের। এর প্রভাব পড়ছে পরবর্তী শিক্ষাজীবনে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাঠদানবহির্ভূত এই ব্যস্ততার চিত্র উঠে এসেছে একটি জরিপে। ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাঠদানের পাশাপাশি অতিরিক্ত সরকারি দায়িত্ব পালন’ শীর্ষক এই জরিপ পরিচালনা করেছে আজকের পত্রিকা। এতে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন একটি দপ্তরের পরিসংখ্যানবিদেরা।
জরিপে বেতনভাতা ও মর্যাদা নিয়ে অধিকাংশ শিক্ষকের অসন্তুষ্টিও উঠে এসেছে। জরিপের ফলাফল দেখে শিক্ষাবিদেরা সরকারি এসব কাজ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে অথবা বেসরকারি সংস্থাকে (এনজিও) দিয়ে করানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
পাঠদানের বাইরে বারোয়ারি কাজ করানোর কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অপেশাদার আচরণ তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। জরিপের ফলাফলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, বহুমুখী কাজ করানোর কারণে সার্বিকভাবে বিদ্যালয়ে শিক্ষায় সংকট তৈরি হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীরা শিখন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে শিখন ঘাটতি, যা নিয়ে শিক্ষার্থীরা উচ্চতর শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হচ্ছে। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুগল ফরমে ১ থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত এই জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এতে অংশ নেন দেশের আট বিভাগের ৪৭ জেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬৯৬ শিক্ষক। এর মধ্যে ৫৩৫ জন সহকারী শিক্ষক ও ১৬১ জন প্রধান শিক্ষক। তাঁদের মধ্যে ৩৪ শতাংশের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ১ থেকে ৫ বছর, ২৪ শতাংশের ৫ থেকে ১০ বছর, ১৬ শতাংশের ১০ থেকে ১৫ বছর, ১৫ শতাংশের ১৫ থেকে ২০ বছর এবং ১১ শতাংশের অভিজ্ঞতা ২০ বছরের বেশি। জরিপের তথ্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মাইক্রোসফট এক্সেল ও এনভিভো সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ বার্ষিক (২০২২-২৩) প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা দেশে ৬৫ হাজার ৫৬৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে ১ কোটি ৭১ লাখ ৬২ হাজার ৩৬৫ জন। শিক্ষক আছেন ৩ লাখ ৬২ হাজার ৭০৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ শিক্ষক ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৯ জন ও মহিলা শিক্ষক ২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৭০ জন।
শিক্ষকেরা ব্যস্ত বারোয়ারি সরকারি কাজে
জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষকেরা অন্তত ২০ ধরনের সরকারি কাজে অংশ নেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-নির্বাচনসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও ভোট গ্রহণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, ভোটারের ছবি তোলার কাজে সহযোগিতা, কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানো, ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন, শিক্ষার্থীদের ওজন ও চোখ পরীক্ষা, শিক্ষার্থীদের এইচপিভি ভাইরাস প্রতিরোধে টিকাদানের রেজিস্ট্রেশন, শিক্ষার্থীদের জরায়ু ক্যানসারের ভ্যাকসিন, ফাইলেরিয়া নির্মূল ও খুদে ডাক্তার কার্যক্রম, ডেঙ্গু সচেতনতা কার্যক্রম, টিসিবির চাল বিতরণ, আদমশুমারি, ভূমি জরিপ, খানা জরিপ, ক্যাচমেন্ট ম্যাপ তৈরি, স্যানিটেশন জরিপ ও মৌসুমি বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন, বিদ্যালয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি।
এগুলোর বাইরে শিক্ষকদের নিজ বিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করতে হয়। প্রশাসনিক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে উপবৃত্তি, বিভিন্ন সমাবেশ আয়োজন (মা সমাবেশ, অভিভাবক সমাবেশ), রেজিস্ট্রার হালনাগাদ, উপবৃত্তি রেজিস্ট্রেশন, উপজেলা-জেলা অফিসে বিভিন্ন সভায় অংশগ্রহণ। এসব কার্যক্রমে অংশগ্রহণের কারণেও শ্রেণিকক্ষে পাঠদান বাধাগ্রস্ত হয় বলে জানিয়েছেন জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষকেরা। তাঁরা বলেছেন, দেশের বেশির ভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম নিরাপত্তা প্রহরী ও অফিস সহায়ক পদ শূন্য রয়েছে। বাধ্য হয়ে এসব পদের কাজও শিক্ষকদের করতে হয়। তাঁরা জরুরি ভিত্তিতে অফিস সহায়ক ও দপ্তরি কাম নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানান।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, ঢাকাসহ বিভিন্ন মহানগর এলাকা ছাড়া দেশের অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম কম্পিউটার অপারেটর, নিরাপত্তা প্রহরী এবং অফিস সহায়ক পদে কোনো জনবল নেই। তাই বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্বও শিক্ষকদেরই পালন করতে হয়।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. সাখাওয়াৎ হোসেন বলেন, মামলাসংক্রান্ত জটিলতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম নিরাপত্তা প্রহরী ও অফিস সহায়ক পদে নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এ সমস্যার সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
পাঠদানের বাইরের কাজে যায় ৬০ কর্মদিবস
জরিপের তথ্য বলছে, পাঠদানের বাইরে বিভিন্ন সরকারি কাজে দায়িত্ব পালনে শিক্ষকেরা বছরে অন্তত ৬০ দিন ব্যয় করেন। অর্থাৎ ওসব কাজের দায়িত্ব পাওয়া শিক্ষকেরা এসব দিনে পাঠদান করাতে পারেন না। বদলি শিক্ষকের ব্যবস্থা করা না গেলে ওই শিক্ষকের ক্লাসগুলো হয় না। এতে বঞ্চিত হয় শিক্ষার্থীরা।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) বিভিন্ন নথিপত্র ও বিভিন্ন সময়ে জারি করা অফিস আদেশ ঘেঁটে সরকারি কাজে নির্বাচিত শিক্ষকদের ৬০ দিন পাঠদানবহির্ভূত কাজে ব্যস্ত থাকার তথ্যের সত্যতা মিলেছে।
একাধিক অফিস আদেশের তথ্য বলছে, প্রাথমিকের শিক্ষকদের নির্বাচনসংক্রান্ত কাজে ১৫ থেকে ৩০ দিন, স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রমে ১৮ দিন, টিসিবির চাল বিতরণ কার্যক্রমে ৭ দিন, মৌসুমি প্রতিযোগিতায় ২ দিন, অন্যান্য কার্যক্রমে অন্তত ৩ দিন সময় দিতে হয়।
২০২৪ শিক্ষাবর্ষে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট কর্মদিবস ছিল ১৮৬ দিন। চলতি শিক্ষাবর্ষেও কর্মদিবসের সংখ্যা প্রায় একই।
প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত পরামর্শক কমিটিও প্রাথমিকের শিক্ষকদের কাজের চাপ কমানোর সুপারিশ করেছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমদের নেতৃত্বাধীন এই কমিটি গত ২৮ ফেব্রুয়ারি তাদের প্রতিবেদন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষকদের শিক্ষণ-শিখনবহির্ভূত কাজের চাপ যুক্তিসংগতভাবে কমিয়ে আনতে হবে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সম্মানী নেই, ইচ্ছার বাইরে বাড়তি কাজ
জরিপে অংশগ্রহণকারীরা জানান, পাঠদানবহির্ভূত সরকারি বিভিন্ন কাজ করলেও বেশির ভাগ শিক্ষক এ জন্য কোনো সম্মানী পান না। জরিপে অংশ নেওয়া ৪৬ শতাংশ শিক্ষক পাঠদানবহির্ভূত সরকারি কাজের জন্য সম্মানী না পাওয়ার কথা জানান। ৪৬ শতাংশ শিক্ষক জানান, কিছু কাজের জন্য সম্মানী দেওয়া হলেও তা পরিশ্রমের তুলনায় অপ্রতুল। বাকি ৮ শতাংশ সম্মানী পান বলে জানিয়েছেন।
জরিপের তথ্য বলছে, বেশির ভাগ শিক্ষক ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সরকারি কাজে অংশ নেন। জরিপে অংশ নেওয়া ৮৪ শতাংশ শিক্ষক জানান, তাঁরা ইচ্ছার বাইরে বাধ্য হয়ে এসব কাজে অংশ নেন। বাকি ১৬ শতাংশ জানান, কর্তৃপক্ষের নির্দেশে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এসব দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষকেরা জানান, এসব দায়িত্ব পালনে অনীহা দেখালে নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সম্মুখীন হওয়ার শঙ্কায় ভোগেন তাঁরা।
শিক্ষকেরা মনে করেন, পাঠের অতিরিক্ত কাজের চাপ তাঁদের মানসিক ও পেশাগত স্বাধীনতায় প্রভাব ফেলছে। এ থেকে পরিত্রাণের পদক্ষেপ নিয়ে তাঁরা সরকারের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন।
কারা দেন অতিরিক্ত কাজের নির্দেশ
জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, পাঠদানবহির্ভূত কার্যক্রমের বেশির ভাগই শিক্ষকেরা করেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার নির্দেশনায়।
শিক্ষকেরা জানান, ৫৩ শতাংশ সরকারি কাজ করার সরাসরি নির্দেশ আসে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে। ২৫ শতাংশ কাজের নির্দেশনা দেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। বাকি কাজগুলো বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষকেরা করেন।
যেমন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ১৫ জুলাইয়ের একটি অফিস আদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের কৃমি সংক্রমণের মাত্রা নির্ণয়ের লক্ষ্যে ১৬ জেলার শিক্ষার্থীদের মল পরীক্ষা করতে শিক্ষকদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার তত্ত্বাবধানে ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের বছরে দুবার কৃমিনাশক ওষুধ সেবন করানো হয়। এই কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য শিশুদের মধ্যে কৃমি সংক্রমণের প্রকৃত অবস্থা জানার প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্য নির্ধারিত জেলাগুলোর শিক্ষার্থীদের মল পরীক্ষা করে একটি জরিপ পরিচালনা করা হবে।
আদেশে আরও বলা হয়, সংশ্লিষ্ট এলাকায় জরিপ কার্যক্রম নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে উপজেলা ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান ও সার্বিক সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবদুল আজিজ বলেন, মূলত অন্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে শিক্ষক-কর্মকর্তারা এসব কাজে (পাঠদানবহির্ভূত) অংশ নেন।
কারা করতে পারেন এসব কাজ
জরিপে অংশ নেওয়া ৪৬ শতাংশ শিক্ষক জানান, ঢালাওভাবে শিক্ষকদের দিয়ে সব কাজ না করিয়ে যে মন্ত্রণালয়ের কাজ সেই মন্ত্রণালয়ের জনবল দিয়েই করানো উচিত। বেকার তরুণ-তরুণীদের দিয়ে এসব কাজ করানোর পক্ষে মত দিয়েছেন ১৫ শতাংশ শিক্ষক। এ ছাড়া অফিস সহকারী নিয়োগ করে এসব কাজ করানোর পরামর্শ ১৯ শতাংশ শিক্ষকদের। বাকি ২০ শতাংশ শিক্ষক জানান, এনজিও, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, কম্পিউটার অপারেটর নিয়োগ দিয়ে এসব কাজ করানো উচিত।
জানতে চাইলে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘প্রাথমিকের শিক্ষকেরা পাঠদানবহির্ভূত বহু কাজের সঙ্গে জড়িত। এই জরিপে যা উঠে এসেছে তা-ই বাস্তব চিত্র। এসব কাজের জন্য পঠন-পাঠনে তাঁদের মন দেওয়া মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে প্রধান শিক্ষক সারাক্ষণই শিক্ষা প্রশাসনেই ব্যস্ত সময় পার করেন।’
ভূমি জরিপ কি শিক্ষার কাজ?—এমন প্রশ্ন করে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, এটা তো ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাজ। টিকার কাজ কি শিক্ষার কাজ? দায়িত্বগুলো ঠিকভাবে বণ্টন করা প্রয়োজন। মাঠপর্যায়ে স্থানীয় সরকারের প্রচুর জনবল আছে। তাদের নেটওয়ার্ক কাজে লাগানো যায়। শিক্ষকদের কোনোভাবেই শ্রেণিকক্ষের বাইরে অতি জরুরি প্রয়োজন বা জরুরি অবস্থা ও দুর্যোগের সময় ছাড়া আর কোনো কাজে যুক্ত করা যাবে না। পঠন-পাঠনসংক্রান্ত বিষয় ছাড়া অন্য কোনো কাজ শিক্ষকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।
বাইরের অতিরিক্ত কাজের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষায়
জরিপে শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, পাঠদানবহির্ভূত অতিরিক্ত কাজের ফলে শিক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে বিকল্প শিক্ষকের অভাবে শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকলে। এতে শিখন ঘাটতি হয়, যা শিক্ষার্থীদের ফলাফলসহ সার্বিক পড়াশোনায় প্রভাব ফেলে।
জরিপে অংশ নেওয়া ৫১ শতাংশ শিক্ষক জানান, বাইরের কাজের চাপে ওই সময় ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয় না। ৩৪ শতাংশ শিক্ষক জানান, মাঝে মাঝে অন্য শিক্ষক দিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম চালানো হয়। ১৫ শতাংশ শিক্ষক জানান, অন্য শিক্ষক ক্লাস নিলেও শিক্ষার্থীদের শিখনে কাজে লাগে না।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অন্তত ১০ শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, পাঠদানের বাইরে বিভিন্ন সরকারি দায়িত্ব পালনের কারণে শিক্ষকেরা প্রায়ই ক্লাস নিতে পারেন না। এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক খায়রুন নাহার লিপি বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি অনেক সরকারি কাজে সম্পৃক্ত থাকতে হয়, যা পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করে। একজন শিক্ষক অতিরিক্ত কাজের চাপ থেকে মুক্ত থাকলে পাঠদানে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। এতে শিশুরাও অনেক কিছু শেখার সুযোগ পাবে।
বেতনভাতা, মর্যাদা নিয়ে অসন্তুষ্ট অধিকাংশ শিক্ষক
জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, বেতনভাতা ও মর্যাদা নিয়ে অধিকাংশ শিক্ষক অসন্তুষ্ট। ৮৭ শতাংশ শিক্ষক জানান, শিক্ষার মান উন্নয়নে বেতনভাতা বৃদ্ধি করতে হবে। এর বাইরে তাঁরা শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করা, মিড ডে মিল চালু, মনিটরিং কার্যক্রম চালু, বিদ্যালয় সময়সূচি পুনর্বিবেচনা, শিক্ষাক্রম উন্নয়ন, পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষের ব্যবস্থা ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানান।
বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ১২তম গ্রেডে বেতন পান। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা বেতন গ্রেড উন্নতির দাবিতে আন্দোলন করছেন। তাঁরা বলছেন, এই গ্রেড তাঁদের পেশার মর্যাদার জন্য সংগতিপূর্ণ নয়।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় গতকাল সোমবার রাতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১০ম গ্রেডে উন্নীত করার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।
যা বললেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা
জরিপের সার্বিক ফলাফলের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার ১৩ জুলাই আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমরা অবগত। কীভাবে শিক্ষাবহির্ভূত কাজে শিক্ষকদের নিয়োগ কমিয়ে আনা যায় সে জন্য আমরা কাজ করছি। আমরাও মনে করি, শিক্ষকদের শিক্ষকতার কাজেই থাকা দরকার। আমাদের দেশের সার্বিক কল্যাণের জন্যই এটি (পাঠদানবহির্ভূত কাজ) থেকে সরে আসা প্রয়োজন।’
বেতনভাতা নিয়ে শিক্ষকদের অসন্তোষ প্রসঙ্গে বিধান রঞ্জন বলেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি অবগত। এ বিষয়ে পরামর্শক কমিটি এ বিষয়ে সুপারিশ দিয়েছে। বিষয়টির বাস্তবায়ন কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।