ভারতে প্রাচীন এক সভ্যতার আবিষ্কার বদলে দিতে পারে আগের সব হিসাব


তামিলনাড়ুর কীলাড়ি গ্রামে খোঁজ মিলেছে আড়াই হাজার বছর আগের এক প্রাচীন নগরসভ্যতার। এই আবিষ্কার এখন ভারতের ইতিহাস ও রাজনীতির উত্তপ্ত বিতর্কে পরিণত হয়েছে। মাদুরাইয়ের কাছাকাছি বৈগাই নদীর তীরে অবস্থিত ওই গ্রামের একটি নারকেল বাগানে ১৫ ফুট গভীর খনন করে উঠে এসেছে মৃৎপাত্রের টুকরো, ইটের গঠনের ধ্বংসাবশেষ, কুণ্ড, পয়সা, রত্নপাথরের মালা এবং প্রাচীন জলনিষ্কাশন ব্যবস্থার চিহ্ন।
তামিলনাড়ু রাজ্যের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মতে—এই সভ্যতার বয়স আনুমানিক ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ বছর। এখানে পাওয়া সবচেয়ে পুরোনো নিদর্শনটি ৫৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের। এই আবিষ্কার ভারতীয় উপমহাদেশের সভ্যতার ইতিহাসে প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচন করছে।
২০১৩ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ অমরনাথ রামকৃষ্ণনের তত্ত্বাবধানে কীলাড়ি গ্রাম খননের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল। পরে মাত্র ৪ একর এলাকায় দশ দফায় খননের মাধ্যমে পাওয়া গেছে ১৫ হাজারের বেশি নিদর্শন। এখনো ৯৬ একর জায়গা খননের অপেক্ষায় রয়েছে।
এই খননকাজের প্রধান প্রত্নতত্ত্ববিদ অজয় কুমার বলেছেন, ‘এখানে আমরা এমন একটি নগরায়িত ও শিক্ষিত সমাজের চিহ্ন পেয়েছি, যেখানে আবাসন, শিল্প ও সমাধিক্ষেত্র আলাদা ছিল। এটি দক্ষিণ ভারতের প্রথম সুসংগঠিত প্রাচীন নগরসভ্যতার প্রমাণ।’
এ বিষয়ে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের সভ্যতার ইতিহাসে এত দিন উত্তর ও মধ্য ভারতের দিকেই দৃষ্টি রাখা হয়েছে। সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতা এবং গঙ্গা অববাহিকার বৈদিক যুগই সেই ইতিহাসের মূল কাহিনি। এই ধারা অনুযায়ী, দক্ষিণ ভারতকে প্রায় সময়ই উন্নত উত্তর ভারতের দ্বারা সভ্য করা হয়েছিল বলে দেখানো হয়। কিন্তু কীলাড়ির আবিষ্কার এই ধারণার বিরুদ্ধে শক্ত যুক্তি হাজির করছে।
বিশেষভাবে বিতর্ক দেখা দিয়েছে ‘তামিল ব্রাহ্মী’ লিপি নিয়ে। এতদিন মনে করা হতো, এটি অশোকের ব্রাহ্মী লিপির শাখা। কিন্তু কীলাড়ির খননে পাওয়া গ্রাফিতি বা লেখাচিহ্ন প্রমাণ করছে, তামিল ব্রাহ্মী ৬ষ্ঠ খ্রিষ্টপূর্বাব্দেই ব্যবহৃত হতো, অর্থাৎ অশোকের সময়েরও আগে। তাই কেউ কেউ বলছেন, তামিল ব্রাহ্মী ও অশোকীয় ব্রাহ্মী হয়তো একই উৎস সিন্ধু লিপি থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করেছে।
আরেকটি আলোচনার বিষয় হলো—সিন্ধু সভ্যতা ও কীলাড়ির মধ্যে সংযোগ। কেউ কেউ মনে করছেন, সিন্ধুর মানুষ দক্ষিণে এসে নগরায়ণের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। তবে অনেকে এর বিরোধিতা করছেন। কারণ এত প্রাচীনকালে এমন বৃহৎ পরিসরের অভিবাসন সম্ভব ছিল না বলে তাঁদের দাবি।
এদিকে এই আবিষ্কারে রাজনীতিও ঢুকে পড়েছে। যার নেতৃত্বে কীলাড়ির খননকাজ শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালে সেই অমরনাথ রামকৃষ্ণনের হঠাৎ বদলি করা হয়। শুধু তাই নয়, ২০২৩ সালে তাঁর রিপোর্টে ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব’ দেখিয়ে এএসআই-এর সংশোধন চাওয়ার ঘটনায় ব্যাপক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্টালিন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ‘তামিল গর্বকে আঘাতের ষড়যন্ত্র’ করার অভিযোগ তুলেছেন। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রী জানিয়েছেন, রিপোর্ট এখনো পর্যালোচনার অধীনে রয়েছে।
বর্তমানে কীলাড়ির খননস্থানে একটি মুক্ত জাদুঘরের কাজ চলছে। স্থানীয় স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন এসে দেখে যাচ্ছে অতীতের এসব চিহ্ন। সাংবাদিক সউমিয়া অশোক বলেন, ‘এই ইতিহাস উন্মোচনের যাত্রা আমাদের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে নতুন সংযোগ তৈরি করে, আজকের বিভাজনের ভেতরেও যা ঐক্যের চিহ্ন।’