দুই শ বছরের ঐতিহ্য ঘিওরের থাপড়ানো রুটি


থাপড়ানো রুটি! নাম শুনেই কেমন করে ওঠে শরীর। কিন্তু বিষয়টি যে মিথ্যে নয়, সেটাও সত্যি।
মানিকগঞ্জের বেশ পুরোনো ঘিওর হাট। সপ্তাহের প্রতি বুধবার হাট বসে। একসময় দেশের অন্যতম বড় হাট হিসেবে পরিচিত থাকলেও এখন তার শরীরে শুধুই কঙ্কাল। হাটের আকার, আয়তন ও গুরুত্ব—সবই কমে গেছে। তবে রয়ে গেছে এই হাটের ‘ঐতিহ্য’ থাপড়ানো রুটি।
বড় বড় আকারের একেকটি থাপড়ানো রুটির সঙ্গে রসে জবজবে রসগোল্লার স্বাদ একবার হলেও যিনি নিয়েছেন, তিনি মনে রাখবেন পুরো জীবন। এমনটাই দাবি প্রাচীন ঘিওর হাটের এই বিশেষ রুটির কারিগরদের।
হাটের বিকিকিনি শেষে বাড়ি ফেরার পথে হাটুরেরা সোজা চলে যান থাপড়ানো রুটির গলিতে। সেখানে সারি সারি দোকান। শোনা যায়, হাটের যৌবনকালে এখানে ছিল এক শর বেশি রুটির দোকান। এক দশক আগেও ছিল ৪০টি দোকান। কিন্তু এখন মাত্র পঁচিশেক দোকান অবশিষ্ট আছে। কালের বিবর্তনে দোকানের সংখ্যা কমলেও থাপড়ানো রুটির চাহিদা আর সুনাম এখনো অক্ষুণ্ন। এর প্রমাণ হলো, ঘিওর হাটে যেদিন কোনো বাড়ির অভিভাবক আসেন, সেদিন পরিবারের বাকি সদস্যরা অপেক্ষায় থাকেন এই থাপড়ানো রুটি ও মিষ্টির।

সম্প্রতি এক হাটের দিন, সেই ঐতিহ্য হারানো রুটির গলি ধরে হাঁটছিলাম। আড়চোখে দেখি, কেউ রুটির দোকানে বসে রুটি খাচ্ছেন, কেউ পরিবারের জন্য কিনে নিয়ে যাচ্ছেন থাপড়ানো রুটি আর মাঝারি আকারের সাদা রসগোল্লা। বেশ ভিড়, চলছে হাঁকডাক আর বেচাকেনা। বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা রুটির ব্যবসা ধরে রেখেছেন এখানকার দোকানিরা। আগের মতো লাভ না হলেও শত বছরের ব্যবসা ধরে রেখেছেন তাঁরা।
হাটের দিন সকাল থেকে শুরু হয় থাপড়ানো রুটি তৈরির বিশাল কর্মযজ্ঞ। রুটি তৈরির কারিগর আর দোকানের দোকানের কর্মচারীরা ব্যস্ত সময় পার করেন। এই রুটির আরেকটি মজার দিক হলো, এগুলো কেজি দরে কেনা যায়। মূলত যাঁরা বাড়ি নিয়ে যান, তাঁরা এই কেজি দরে রুটি কেনেন।

সাপ্তাহিক হাটের দিন থাপড়ানো রুটির চাহিদা বেশি থাকে। এদিন প্রতিটি দোকান মালিক এক শ থেকে দেড় শ কেজি থাপড়ানো রুটি বিক্রি করেন। আবার কারও কারও বিক্রি ২০০ কেজি। তবে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে এর চাহিদা কিছুটা কম থাকে।
ঘিওরের পার্শ্ববর্তী উপজেলার নাম দৌলতপুর। সেখানকার ধামশ্বর গ্রামের ভুট্টা ব্যবসায়ী লাল মিয়া ঘিওর হাটে এসেছিলেন ৫০ মণ ভুট্টা নিয়ে। সেই ভুট্টা বিক্রির বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষে তিনি এসেছেন থাপড়ানো রুটি কিনতে। লাল মিয়া জানালেন, তিনি প্রায় প্রতি বুধবার ঘিওরের হাটে আসেন। বেচাকেনা শেষে বাড়ি ফেরার পথে থাপড়ানো রুটি খান এবং বাড়ি নিয়ে যান। শিশুরা খুব খুশি হয়। তাঁর স্ত্রীও এই রুটি পছন্দ করেন। এ জন্য দুই শ টাকার থাপড়ানো রুটি আর এক কেজি রসগোল্লা কিনেছেন সেদিন।
রুটির দোকানি জিতেন দাস জানালেন, তাঁর দাদা ও বাবা ঘিওরে এই থাপড়ানো রুটির ব্যবসা করছেন। আর তিনি নিজে সেই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ২২ বছর ধরে। থাপড়ানো রুটির চাহিদা ভালো বলেই ধারণা তাঁর। হাটের দিন ৪০-৫০ কেজি রুটি বিক্রি করেন তিনি। লাভ কেমন হয় জানতে চাইলে বলেন, ‘রুটি বেইচা আগের মতো লাভ হয় না।’

হাটের বড় রুটির দোকানটির মালিক শহিদুল ইসলাম বলেন, প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্য থাপড়ানো রুটির। খেতে সুস্বাদু, কেজি দরে বিক্রিও করি। রুটির আকার অনুযায়ী ৯০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। প্রতি হাটে দুই শ থেকে আড়াই শ কেজি রুটি আর ২ মণ মিষ্টি বিক্রি হয়।
বিজয় রুটি-মিষ্টান্ন ভান্ডার নামের একটি দোকানে চেয়ারে আরাম করে বসে সস্ত্রীক থাপড়ানো রুটি আর মিষ্টি খাচ্ছিলেন মধ্য ষাট বছরের মুনছের মিয়া। তিনি জানান, স্ত্রীর আবদারে এই বয়সেও হাটে এসে থাপড়ানো রুটি আর রসগোল্লা খাচ্ছেন তিনি।
থাপড়ানো রুটি তৈরির এক কারিগর রিপন মিয়া। তিনি জানালেন, থাপড়ানো রুটি ঘিওরের ঐতিহ্য। স্বাদ ও মান ভালো। তাই এ রুটির চাহিদা বেশি। রিপন আরও বললেন, তিনি ৩৭ বছর ধরে এ রুটি বানিয়ে চলেছেন। এই কাজ করে পাওয়া টাকা দিয়েই তিনি পাঁচ সদস্যের সংসার চালান। তিনি দুই মেয়েকে স্কুল ও কলেজে পড়াচ্ছেন। রিপন জানালেন, আগে তিনি প্রতিদিন পেতেন ৩০০ টাকা, এখন রোজ পান ৬৫০ টাকা।
ঘিওর হাট বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক পলাশ খান পাষাণ। এই হাটের থাপড়ানো রুটির ইতিহাস তিনি কথায় কথায় দুই শ বছর পেছনে নিয়ে যান। পাষাণ বললেন, ‘আমরা একসময় এই হাট নিয়ে গর্ব করতাম। তার অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল গরুর হাট, থাপড়ানো রুটি এবং পাট। তবে গরুর হাটটি নদীতে বিলীন হয়েছে। আগের মতো এখন আর ধান, পাটও ওঠে না। এখন ঐতিহ্য বলতে যা আছে, তা হলো থাপড়ানো রুটি।’
ঘিওর হাটে এই থাপড়ানো রুটির ইতিহাস নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলতে থাকে। আমরা খুঁজে ফিরি এর অতীত। ঘিওর হাট তো শুধু বিক্রিবাট্টার জায়গা ছিল না; ছিল সপ্তাহান্তের মিলনমেলা। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসত জিনিসপত্র বেচা ও কেনার জন্য। সেখানে ধান-পাট-গরু-ছাগল যেমন থাকত, তেমনি থাকত জিলাপি ও রসগোল্লার সঙ্গে থাপড়ানো রুটি। হাটের যৌবন যেমন অস্তে গেছে, তেমনি কমেছে এখানে রুটির দোকানের সংখ্যা। কমতে কমতে হয়তো একদিন এই থাপড়ানো রুটি থাকবে শুধুই গল্পে। তখনো মানুষ হয়তো এর স্বাদ আর বয়স নিয়ে অলস আড্ডায় মাতামাতি করবে।