জলবায়ু, শিল্পবর্জ্য আর বৈরীআবহাওয়ায় বিপাকে জেলেরা


এখন চলছে ইলিশের ভরা মৌসুম। ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে ১১ জুন মধ্যরাত থেকে জেলেরা ইলিশ শিকারে নেমেছিলেন নদী-সাগরে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে ধরা পড়ছে না এই মাছ। এর জন্য ভোলায় নদীর তলদেশে অসংখ্য ডুবোচর এবং চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সন্দ্বীপ চ্যানেলে জলবায়ু পরিবর্তন ও শিল্পকারখানার বর্জ্যের প্রভাবকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই অবস্থার মধ্যেই আবহাওয়া এখন বৈরী হয়ে উঠেছে। ফলে সাগর-নদীতে নামতেই পারছেন না জেলেরা। এদিকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ইলিশ ধরা না পড়ায় বাজারেও দাম চড়া।
ভোলার মৎস্য অফিসের কর্মকর্তা, জেলে, আড়তদার, মাছ ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপকূলীয় এই দ্বীপ জেলায় নদীর তলদেশে অসংখ্য ডুবোচর তৈরি হয়েছে। ফলে পানির প্রবাহ কমে গেছে। এতে নদীতে মাছ প্রবেশে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। আর সীতাকুণ্ড উপজেলা মৎস্য বিভাগ বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং শিল্পকারখানার বর্জ্যের কারণে সন্দ্বীপ চ্যানেলে ইলিশের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তাই ভরা মৌসুমেও কাঙ্ক্ষিত ইলিশ ধরা পড়ছে না।
ভোলার সাত উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ বিভিন্নভাবে সাগর ও নদীর মৎস্য আহরণ এবং মাছ ব্যবসায় জড়িত। এখানকার মাছ দেশীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হয়।
জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাছের উৎপাদন বাড়াতে সরকার প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞা দেয়। নিষেধাজ্ঞা শেষে জেলেরা বুকভরা আশা নিয়ে সাগর ও নদীতে গিয়ে নেমেছিলেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মাছ পাচ্ছেন না তাঁরা, উঠছে না নৌকার তেলের খরচও। এদিকে মাছ ধরার সরঞ্জাম কিনতে ক্ষুদ্রঋণ বা মহাজনের দাদন নেন জেলেরা। মাছ ধরতে না পেরে সমিতির কিস্তি, মহাজনের দাদনের চাপ, দোকানের দেনা, সন্তানদের পড়ালেখার খরচসহ পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন তাঁরা।
জেলেদের অভিযোগ, সরকারিভাবে জেলেদের প্রণোদনার যে চাল আসে, অধিকাংশ জেলেই তা পান না। চাল চলে যায় প্রভাবশালীদের ঘরে।
গতকাল শনিবার ভোলা সদরের মেঘনাপারের মাছ ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, জেলে মনির বেলা ১১টায় নদীতে মাছ শিকারে নেমে সন্ধ্যা ৬টায় ঘাটে ফেরেন ছোট আকারের চারটি ইলিশ নিয়ে। এগুলোর দাম ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা।
ভোলা খাল এলাকার মাছ ঘাটের আড়তদার এবং শিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য মাইনুদ্দিন বলেন, এ বছর ইলিশের অবস্থা খুবই খারাপ। গত বছর এই সময়ে এই আড়তে যেখানে দৈনিক প্রায় অর্ধকোটি টাকার ইলিশ বেচাকেনা হতো, এ বছর এখন দৈনিক ১ লাখ টাকার ইলিশও বেচাকেনা হচ্ছে না। নদীতে ডুবোচরের কারণে মাছ কমে গেছে।
এদিকে পর্যাপ্ত ইলিশ ধরা না পড়ায় বাজারে ইলিশের দামও চড়া। ছোট আকারের ইলিশের দাম কেজিপ্রতি ১২০০-১৩০০ টাকা। আর এক কেজির ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার টাকায়।
জানতে চাইলে ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব আজকের পত্রিকাকে বলেন, সাগর ও নদীমধ্যবর্তী স্থানে শতাধিক ডুবোচর সৃষ্টি হওয়ায় পানিপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে সাগর থেকে ভোলার মেঘনা, তেঁতুলিয়া, কালাবাদর, বেতুয়া ও ইলিশা নদীতে ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আসতে পারছে না। পানি আরও বাড়লে মাছ আসতে শুরু করবে।
সীতাকুণ্ডে ইলিশশূন্য সন্দ্বীপ চ্যানেল
সীতাকুণ্ডের জেলেরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞা-পরবর্তী সময়ে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলেও সাগরে কাঙ্ক্ষিত ইলিশের দেখা মেলেনি। এর মধ্যেই গত শুক্রবার সকাল থেকে আবহাওয়া বৈরী হয়ে উঠেছে। এতে সাগরে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে গেছে।
উপজেলা মৎস্য বিভাগের তথ্যনুযায়ী, চলতি মৌসুমে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সীতাকুণ্ডে ইলিশ ধরা পড়েছে ২৩০ দশমিক ৪ টন, যা গতবারের তুলনায় প্রায় ৪০৩ টন কম। এই উপজেলায় ৬ হাজার জেলে পরিবারের বসবাস। নিবন্ধিত জেলে পরিবারের সংখ্যা ৫ হাজার ৪০০।
বৃহস্পতিবার দুপুরে সীতাকুণ্ডের কুমিরা ঘাটে জেলে সরদার বিপ্লব জলদাস আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রতিবছর ইলিশের মৌসুমে সাগরে মাছ ধরার জন্য তিনি ৫ থেকে ৭ জন শ্রমিক রাখতেন। এবারও তাঁদের রেখেছিলেন। কিন্তু খরচের তুলনায় কাঙ্ক্ষিত ইলিশ না পাওয়ায় লোকসানে পড়েছেন তিনি। তাই বাধ্য হয়ে চার শ্রমিককে বিদায় করে দিয়েছেন।
উপজেলা মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, এই উপজেলায় ২০২১-২২ অর্থবছরে ইলিশ ধরা পড়েছিল ১ হাজার ৪৫৫ দশমিক ৯২ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২ হাজার ৩১ দশমিক ৭৫ টনে। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অনেকটা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৭৩৫ দশমিক ৭৩ টনে। এবার তা আরও কমে গেছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৩০ দশমিক ৪ টন ইলিশ আহরণ করা হয়েছে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, এ বছর জেলেদের জালে আশানুরূপ ইলিশ ধরা পড়েনি। আর বৈরী আবহাওয়ার কারণে গত শুক্রবার সকাল থেকে মাছ ধরাই বন্ধ রয়েছে।
কর্মহীন হাতিয়া ও শরণখোলার জেলেরাও নোয়াখালীর হাতিয়া ও বাগেরহাটের শরণখোলায়ও এবার কাঙ্ক্ষিত ইলিশ মিলছে না। তার ওপর বৈরী আবহাওয়ার কারণে সাগর উত্তাল থাকায় গত দুদিন মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে। ফলে কর্মহীন সময় পার করছেন এসব জায়গার জেলেরা।
হাতিয়া ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি রাশেদ উদ্দিন বলেন, গত বছর ঝড়ের কবলে পড়ে হাতিয়ায় বেশ কয়েকটি ট্রলার ডুবে যায়। নিখোঁজ হন পাঁচজন। তাঁদের মধ্যে নিঝুমদ্বীপ ও জাহাজমারায় তিনজনের লাশ পাওয়া যায়। বাকি দুজন এখনো নিখোঁজ। এ কারণে এবার কেউ বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে মাছ ধরতে যেতে চায়নি।
শরণখোলা রাজৈর মৎস্যঘাটের আড়তদার কবীর হোসেন বলেন, একেকটি বোট সাগরে পাঠাতে কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা খরচ হয়। কিন্তু সাগরে যে মাছ পাওয়া যায়, তাতে খরচের টাকা ওঠে না। তার ওপর বৈরী আবহাওয়া। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন শরণখোলা (বাগেরহাট) প্রতিনিধি ফরিদ খান মিন্টু এবং হাতিয়া (নোয়াখালী) প্রতিনিধি ইসমাইল হোসেন কিরণ]