শিরোনাম

শুল্কের শঙ্কার মধ্যে মাশুলের চাপ

শুল্কের শঙ্কার মধ্যে মাশুলের চাপ

বাংলাদেশের পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্কের চাপে ব্যবসায়ীরা যখন অস্থির, ঠিক সে সময় চট্টগ্রাম বন্দর ও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোর (আইসিডি) চার্জ বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ (মাশুল) ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ ও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোর (আইসিডি) চার্জ ২৯ থেকে ১০০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।

২৪ জুলাই বন্দরের প্রস্তাব অনুমোদনও দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আইন মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় পেলেই গেজেট প্রকাশ হয়ে কার্যকর হবে। এদিকে আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হতে চলেছে আইসিডির বর্ধিত চার্জ।

আমদানি-রপ্তানির প্রধান দুই গেটওয়ের এভাবে চার্জ বাড়ানোর ঘোষণায় উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের বক্তব্য, রাজনৈতিক অস্থিরতায় এক বছর ধরে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম বন্দর ও আইসিডি মালিকদের চার্জ বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। ফলে অস্থির হয়ে উঠতে পারে দেশের পুরো অর্থনীতি।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ডিপোগুলোর ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়েছে, ৩৮ ধরনের পণ্য থেকে এখন ৬৫ ধরনের পণ্য হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে। ব্যবসা যখন বাড়ছে তখন চার্জ বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। চার্জ বাড়ালে এর বোঝা পড়বে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকের ওপর। এতে পণ্যের মূল্য বাড়বে এবং সাধারণ জনগণের ওপর চাপ আরও বাড়বে।’

ব্যবসায়ীদের মতামত উপেক্ষা করে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের প্রেসক্রিপশনেই সরকার আগেভাগে ট্যারিফ বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করেন, দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের উপমহাব্যবস্থাপক (হিসাব বিভাগ) তসলিম শাহরিয়ার। এর প্রভাব পড়বে দেশের ১৭ কোটি মানুষের ওপর।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, দীর্ঘ ৩৯ বছর পর চার্জ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশপাশের দেশের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনারপ্রতি চার্জ এখনো অনেক কম। যেমন– কলম্বোতে এক টিইইউসের আনলোডিং চার্জ ১০০ ডলার, সিঙ্গাপুরে ৭৫ ডলার। চট্টগ্রামে এটি মাত্র ৪৩ দশমিক ৪০ ডলার। তিনি আরও বলেন, এর আগেও একাধিকবার চার্জ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে ব্যবসায়ীদের অনুরোধে তা বারবার পেছানো হয়।

অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ৩৯ বছর পর এই ট্যারিফ বৃদ্ধি কোনোভাবেই অযৌক্তিক কিছুই না। কিন্তু একবারেই এতখানি না বাড়ালে ভালো হতো। একসঙ্গে এত ট্যারিফ বৃদ্ধি অর্থনীতিতে একটা নেগেটিভ প্রভাব পড়তে পারে।

চট্টগ্রাম বন্দর ও আইসিডির মালিকদের তথ্যমতে, দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে চট্টগ্রাম বন্দর ও ১৯টি বেসরকারি আইসিডি। গত অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর সব খরচ মিটিয়ে ২ হাজার ৯১২ কোটি টাকা আয় করেছে। আগের অর্থবছরেও তাদের প্রায় একই রকম মুনাফা হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় শতকোটি টাকা আয় করেছে বেসরকারি ১৯টি আইসিডি।

চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন প্রস্তাবে প্রতিটি ২০ ফুট একক কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ ১৫ ডলার থেকে বাড়িয়ে ২৩ দশমিক ১৫ ডলার এবং ৪০ ফুট কনটেইনারের ক্ষেত্রে ২২ দশমিক ৫০ ডলার থেকে ৩৪ দশমিক ৮৩ ডলার করার কথা বলা হয়েছে। জাহাজ পাইলটিং চার্জ ৩৫৭ ডলার থেকে ৭০০ ডলারে উন্নীত করার প্রস্তাব রয়েছে। বন্দরের প্রস্তাবিত ৫৬টি সেবার মধ্যে ১৮ খাতে ৬০ শতাংশের বেশি, ১৭ খাতে ২০ থেকে ৫৯ শতাংশ এবং ১৯ খাতে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ট্যারিফ বাড়ানোর প্রস্তাব গেছে মন্ত্রণালয়ে। মাশুল কমানোর প্রস্তাব গেছে মাত্র দুটি খাতে।

বন্দর কর, বার্থিং ফি, ফর্কলিফট চার্জ, অন্য ইউটিলিটি খরচসহ মাত্র পাঁচটি সেবার হার ২০০৭-০৮ অর্থবছরে সামান্য পরিবর্তন হলেও বাকি সব চার্জ ১৯৮৬ সালের পর থেকে অপরিবর্তিত রয়েছে।

অন্যদিকে বেসরকারি আইসিডির নতুন চার্জে প্রভাব পড়বে অন্তত ২৫ ধরনের সেবায়। এত দিন বিনা মূল্যে হয়েছে, এমন ছয় ধরনের সেবায়ও এবার নতুন চার্জ যুক্ত করেছে তারা। প্রায় শতভাগ রপ্তানি পণ্য ও ৬৫ ধরনের আমদানি পণ্য হ্যান্ডলিং করে বেসরকারি আইসিডিগুলো।

কোন সেবায় কত বাড়ছে ট্যারিফ

জানা গেছে, প্রায় ১৮ হাজার টন ধারণক্ষমতার একটি জাহাজের বন্দরে প্রবেশ ফি বর্তমানে ৪ হাজার ৩৬২ ডলার। এটি ৫৬ শতাংশের বেশি বাড়িয়ে ৬ হাজার ৮৩৪ ডলার নির্ধারণ করার প্রস্তাব এসেছে। একইভাবে পাইলটেজ চার্জের ক্ষেত্রে প্রায় ৯৬ শতাংশ এবং লোডিং-আনলোডিং চার্জ ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

২০২২ সালে স্পেনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মেসার্স আইডম কনসাল্টিং, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড আর্কিটেকচার এবং বাংলাদেশের লজিক ফোরাম লিমিটেডকে ট্যারিফ কাঠামো পর্যালোচনা ও নতুন প্রস্তাবনা তৈরির জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের পরামর্শ মেনেই নতুন চার্জ নির্ধারণ করা হচ্ছে।

ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, ‘বন্দর ১৯৮৬ সালের পর শুল্ক বাড়ায়নি দাবি করলেও তা সঠিক নয়। ১৯৮৬ সালে ডলারের রেট কত ছিল। আর এখন কত, এটি বিবেচনায় আনলেও বোঝা যায় আমাদের খরচ কত বেড়েছে।’

আইসিডির কত চার্জ বাড়ছে

বিকডার বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, একটি ২০ ফুট রপ্তানি কনটেইনারের হ্যান্ডলিং চার্জ ৬ হাজার ১৮৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯ হাজার ৯০০ টাকা, ৪০ ফুট কনটেইনারের চার্জ ৮ হাজার ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১৩ হাজার ২০০ টাকা এবং ৪৫ ফুট হাই-কিউব (উঁচু) কনটেইনারের চার্জ ৮ হাজার ২৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪ হাজার ৯০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) মহাসচিব রুহুল আমিন শিকদার বলেন, ‘গত কয়েক বছরে ইনফ্রাস্ট্রাকচার খরচ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। চলমান উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, টাকার অবমূল্যায়ন এবং ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধির ফলে খরচ বেড়ে গেছে। টিকে থাকতে আমরা এই চার্জ বাড়াচ্ছি।’

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান তৈরি পোশাকশিল্পের নাজুক পরিস্থিতিতে রপ্তানিতে মাশুল না বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছেন। ২১ জুলাই বিকডার সভাপতি বরাবর দেওয়া পত্রে জানা যায়, বিকডা ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ মাশুল বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। তৈরি পোশাকশিল্পের সংকটময় পরিস্থিতি বিবেচনায় নোটিশটি প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হয়।



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button