হামাস ত্রাণ চুরি করেনি, ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তাদের স্বীকারোক্তি


গাজায় চলমান যুদ্ধের মধ্যে ইসরায়েল বহুদিন ধরে দাবি করে আসছিল যে, হামাস জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ত্রাণ চুরি করছে। এই অভিযোগকে সামনে রেখেই তারা সেখানে খাদ্য সরবরাহে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। তবে এখন জানা যাচ্ছে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এমন কোনো প্রমাণই পায়নি যে—হামাস পদ্ধতিগতভাবে জাতিসংঘের ত্রাণ চুরি করেছে।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই গাজায় সবচেয়ে বেশি ত্রাণ সরবরাহ করেছে জাতিসংঘ। সাবেক ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তারাও বলছেন, জাতিসংঘের ত্রাণ ব্যবস্থার কিছু দুর্বলতা থাকলেও তা মূলত কার্যকর ছিল এবং ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে সহায়তা পৌঁছেছিল।
বর্তমানে গাজায় অনাহারে ভোগা মানুষের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, অনেক রোগী খাদ্যের অভাবে মারা যাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপও বাড়ছে। গত সপ্তাহে একযোগে ১০০ টিরও বেশি সাহায্য সংস্থা এবং মানবাধিকার গোষ্ঠী গাজায় ‘ব্যাপক ক্ষুধার’ বিষয়ে সতর্ক করেছে। তারা ইসরায়েলের প্রতি মানবিক সহায়তার বাধা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডাসহ ২৮টি দেশ এক যৌথ বিবৃতিতে গাজার ২০ লাখ মানুষের জন্য ইসরায়েলের ‘ধীর গতির ত্রাণ সরবরাহ’ নীতির সমালোচনা করেছে। তবে, ইসরায়েল এই সমালোচনা পাত্তা দিতে নারাজ। দেশটির সরকারি মুখপাত্র ডেভিড মেনসার দাবি করেছেন, ‘ইসরায়েলের কারণে কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি।’ তিনি বরং এর জন্য হামাস ও জাতিসংঘের দুর্বল সমন্বয় ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন।
নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, জাতিসংঘ পরিচালিত ত্রাণ ব্যবস্থা ছিল তুলনামূলকভাবে নির্ভরযোগ্য এবং সেখানে হামাসের হস্তক্ষেপের আশঙ্কা ছিল কম। কারণ জাতিসংঘের কর্মকর্তারা নিজেরাই সরবরাহ ও বিতরণ করত, তৃতীয় পক্ষের ওপর নির্ভরশীল ছিল না।
ইসরায়েলের ভাষ্যমতে, হামাস কিছু ছোট সংস্থার কাছ থেকে ত্রাণ নিয়ে থাকতে পারে। তবে জাতিসংঘের কাছ থেকে নিয়মিত ত্রাণ চুরি করেছে, এমন কোনো প্রমাণ নেই। একই তথ্য উঠে এসেছে মার্কিন সরকারের এক অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণেও। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত ত্রাণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে হামাসের পদ্ধতিগত চুরির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
যুদ্ধের শুরু থেকে প্রায় ১৩ মাস ইসরায়েলের সঙ্গে ত্রাণ সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা জর্জিয়স পেট্রোপোলোস বলেন, ‘আমরা (জাতিসংঘ) ও অন্যান্য সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে এই অভিযোগের মুখে পড়েছি যে, হামাস আমাদের ত্রাণ চুরি করছে। অথচ বাস্তবে তার কোনো প্রমাণ ছিল না।’
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, হামাস মানবিক সহায়তার অপব্যবহার করেছে, যা বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে তারা এও স্বীকার করেছে যে, জাতিসংঘের কাছ থেকে ‘নিয়মিত ত্রাণ চুরির’ মতো কিছু তারা ‘শনাক্ত করতে পারেনি।’
এদিকে, গতকাল শনিবার রাতে ইসরায়েল ঘোষণা করেছে, তারা আবারও উড়োজাহাজ থেকে ত্রাণ ফেলার প্রক্রিয়া শুরু করে। এ ছাড়া গাজায় ‘মানবিক করিডর’ দিয়ে ত্রাণবাহী যান চলাচলের পথ সহজ করা হবে বলেও জানানো হয়েছে। তবে এসব পরিকল্পনা কেমন হবে, তা বিস্তারিত জানায়নি তারা।
গত বছর আকাশ থেকে ত্রাণ ফেলতে গিয়ে কিছু ত্রাণ গাজাবাসীর ওপর এবং কিছু ত্রাণ সাগরে বা ইসরায়েলের অভ্যন্তরে পড়ায় সেই ব্যবস্থা বন্ধ করা হয়েছিল। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, উত্তর গাজায় শনিবার রাতে প্রথম দফা বিমান থেকে ত্রাণ ফেলা হয়েছে। এরপর রোববার থেকে বিদেশি বিমানবাহিনীগুলো এ দায়িত্ব নেবে।
এর আগে মে মাসে ইসরায়েল জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন ত্রাণ ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে একটি বেসরকারি, যুক্তরাষ্ট্র-পরিচালিত নতুন ত্রাণ ব্যবস্থা চালু করে। এই ব্যবস্থায় মার্কিন ঠিকাদারদের মাধ্যমে ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানো হয়। তবে এই নতুন ব্যবস্থায় বিপদের ঝুঁকি আরও বেড়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এই ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রায় ১ হাজার ১০০ জন ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন।