শিরোনাম

শ্রেণিকক্ষ সুশৃঙ্খল রাখার কৌশল

শ্রেণিকক্ষ সুশৃঙ্খল রাখার কৌশল

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের দায়িত্ব কি শুধুই পাঠদান? আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা বলছে, না। একজন শিক্ষক শুধু পাঠ্যবই শেখানোতে ব্যস্ত থাকেন না, তিনি একটি শিশু বা কিশোরকে গড়ে তোলেন দায়িত্ববান, আত্মসচেতন এবং নৈতিক মানুষ হিসেবে। আর এমন মানুষ তৈরিতে প্রয়োজন শৃঙ্খলা, আচরণগত দিকনির্দেশনা এবং ইতিবাচক মূল্যবোধের চর্চা।

বহু বছর ধরে শ্রেণিকক্ষে শৃঙ্খলা মানেই ছিল শাস্তি। নিয়ম ভাঙলে বকুনি, রাগ দেখানো বা শাস্তি দেওয়া। কিন্তু আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এসেছে পরিবর্তন। এখন শৃঙ্খলা মানে কঠোরতা নয়, বরং শিক্ষার্থীর ভুল নিজে বোঝার ও সংশোধন করে দেওয়ার সুযোগ। এই দৃষ্টিভঙ্গির একটি কার্যকর প্রয়োগ হলো ক্লাসরুম ডিসিপ্লিন স্ট্র্যাটেজি। এ কৌশল ইতিবাচক আচরণকে উৎসাহিত করে এবং নেতিবাচক আচরণকে সহানুভূতির সঙ্গে সংশোধনের সুযোগ দেয়।

শৃঙ্খলার নতুন সংজ্ঞা

ধরা যাক, একজন শিক্ষার্থী বারবার দেরি করে ক্লাসে আসে বা চিৎকার করে উত্তর দেয়। পুরোনো ব্যবস্থায় হয়তো সে শাস্তি পেত, বকুনি খেত। এতে তার মধ্যে ক্ষোভ জন্মাত, শেখার আগ্রহ কমে যেত। কিন্তু ইতিবাচক শৃঙ্খলা পদ্ধতিতে তাকে শেখানো হয়—কেন সময়মতো আসা জরুরি, কেন শোনার পর উত্তর দেওয়া শ্রেয়। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) বলছে, ‘ইতিবাচক শৃঙ্খলা শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে, আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখায় এবং দীর্ঘমেয়াদি আচরণগত পরিবর্তন আনে।’

শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনের ছয় ভিত্তি

ক্লাসরুম ডিসিপ্লিন স্ট্র্যাটেজিতে শিক্ষার্থীদের জন্য ছয়টি মৌলিক নিয়ম নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো চাপিয়ে দেওয়া কোনো নিয়ম নয়, বরং নৈতিকতা ও সামাজিকতা বিকাশের সহায়ক অভ্যাস।

সবাইকে সম্মান কর: শ্রেণিকক্ষ একটি ছোট সমাজ। শিক্ষক, সহপাঠী এবং নিজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ একজন শিক্ষার্থীকে সহনশীলতা ও মানবিকতা শেখায়।

হাত তুলে কথা বল: এটি শুধু শৃঙ্খলার প্রতীক নয়, বরং শোনার ও বলার ভারসাম্য গড়ে তোলে।

নিজের স্থান পরিষ্কার রাখ: পরিচ্ছন্নতাচর্চা শিক্ষার্থীর দায়িত্ববোধ ও পরিবেশ সচেতনতা তৈরি করে।

সততা ও সদয়তা বজায় রাখ: সত্যবাদিতা ও সদয়তার চর্চা মানুষের মধ্যে সৌজন্য ও সহমর্মিতা গড়ে তোলে।

অনুমতি ছাড়া সিট ছেড়ে উঠবে না: নীরবতা ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে এটি গুরুত্বপূর্ণ।

সহপাঠীদের সাহায্য কর: সহযোগিতা ও নেতৃত্বের চর্চা শুরু হয় এখান থেকেই।

শাস্তি নয়, উৎসাহ দিন

ইতিবাচক আচরণকে উৎসাহ দিতে পুরস্কারভিত্তিক পদ্ধতি কার্যকর। যেমন নিয়মিত হোমওয়ার্ক জমা দিলে ১ স্টার; সহপাঠীকে সহায়তা করলে ৩ স্টার এবং প্রশ্নের উত্তর দিলে ১ স্টার। এই স্টারগুলো জমিয়ে শিক্ষার্থী অর্জন করতে পারে ৫ স্টারে ‘স্টার অব দ্য উইক’ সনদ; ১০ স্টারে সারপ্রাইজ গিফট, স্টিকার বা ব্যাজ। এই পদ্ধতির ভিত্তি মন্টেসরি শিক্ষা ও পিবিআইএস (পজিটিভ বিহেভিয়ার ইন্টারভেনশনস অ্যান্ড সাপোর্টস)। এতে শিশুরা শিখতে পারে, প্রতিযোগিতার মাঝেও মানবিক থাকা যায়। কাউকে পেছনে ফেলার নয়, বরং নিজেকে উন্নত করার প্রতিযোগিতা।

নিয়ম ভাঙলে কী হবে?

শাস্তির পরিবর্তে শিক্ষার্থীকে ধাপে ধাপে বোঝানো হয়—

প্রথমবার: মৌখিক সতর্কতা

দ্বিতীয়বার: নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ‘টাইম-আউট’

তৃতীয়বার: অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ

চূড়ান্ত ধাপ: প্রধান শিক্ষকের হস্তক্ষেপ

এই ধারা শিক্ষার্থীদের শেখায়, তাদের আচরণের দায়ভার তার নিজের। কথা না বলেও নির্দেশ দেওয়া যায়।

শ্রেণিকক্ষে সব সময় উচ্চস্বরে কিছু বোঝানোর প্রয়োজন নেই। শিক্ষক ব্যবহার করতে পারেন কিছু ‘সাইলেন্ট সিগন্যাল’:

হাত তুললে — শ্রেণিকক্ষ চুপ হয়ে যায়

ঘণ্টা টোকা—শান্ত পরিবেশ সৃষ্টি

চোখের ইশারা—শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে দাঁড়ানো

এগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও দায়িত্ববোধ তৈরি করে।

বিশ্বদৃষ্টিতে শৃঙ্খলা শিক্ষা

ইউনেসকো তার শিক্ষা ২০৩০ ঘোষণাপত্রে বলেছে, ‘শুধু পরীক্ষার ফল নয়, শিক্ষার্থীর সামাজিক ও নৈতিক বিকাশই মানসম্পন্ন শিক্ষার অন্যতম উপাদান।’ ক্লাসরুম ডিসিপ্লিন স্ট্র্যাটেজি সেই লক্ষ্যেই কাজ করে—শ্রেণিকক্ষকে মানবিক ও ইতিবাচক পরিবেশে রূপান্তর করতে।

সফল মানুষ গঠনে শৃঙ্খলা অপরিহার্য

একটি আদর্শ শ্রেণিকক্ষ মানে শুধুই পাঠদান নয়, বরং এমন এক পরিবেশ; যেখানে শিশুরা শেখে, অনুভব করে এবং মানুষ হয়ে ওঠে। শৃঙ্খলা মানে ভয় দেখানো নয়, এটি আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখার প্রক্রিয়া। শিক্ষার্থীদের আচরণ শুধরে দেওয়া নয়, বরং নিজেকে বুঝে উন্নত করার সুযোগ দেওয়া—এই হোক শিক্ষকের লক্ষ্য।

তথ্যসূত্র: আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন; ইউনেসকো, শিক্ষা ২০৩০; মন্টেসরি ফাউন্ডেশন



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button