ভূতের ভয় কাটানো সম্ভব, তবে যে দুই ভয় জন্মগত


আপনি আগা-গোড়া একজন আধুনিক মানুষ। ভূত-প্রেত বা অতিপ্রাকৃত বস্তুতে বিশ্বাস করেন না মোটেই। তবুও গভীর রাতে কোনো অশ্বথ গাছের নীচ দিয়ে হেঁটে যেতে আপনার গা ছমছম করে। দ্রুতবেগে অশ্বথের ছায়া মাড়ানোর চেষ্টা করেন। কখনো কি ভেবেছেন এই ভয়ের শেকড় কী? এটি কি জন্মগত না পারিবারিক-সামাজিক শিক্ষার ফল?
গবেষণা বলছে, আপনার এই ভয় জিনগত বা প্রাকৃতিক নয়, বরং শিখন প্রক্রিয়ার ফল। তার মানে এই নয় যে, সব ভয়ই কৃত্রিম। মানুষের জন্মগত কিছু ভয়ও রয়েছে। তবে সেই সংখ্য মাত্র দুটি। একটি হলো উঁচু থেকে পড়ে যাওয়ার ভয়, অপরটি বিকট শব্দে চমকে ওঠার ভয়। এই দুটি ছাড়া বাকি সব ভয়— সাপ, অন্ধকার, মঞ্চভীতি সবই জীবনের নানা অভিজ্ঞতায় গড়ে ওঠে।
পড়ে যাওয়ার ভয়, ‘ভিজ্যুয়াল ক্লিফ’ পরীক্ষা
মানব শিশুর এই দুই প্রাথমিক ভয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গবেষণা করছেন মনোবিজ্ঞানী ও স্নায়ুবিজ্ঞানীরা। যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬০ সালের বিখ্যাত ‘ভিজ্যুয়াল ক্লিফ’ পরীক্ষায় দেখা যায়, ৬–১৪ মাস বয়সী শিশুরা স্বচ্ছ কাচের নিচে ফাঁকা জায়গা দেখে স্বাভাবিকভাবে থমকে যায়। এটি প্রমাণ করে, উঁচু থেকে পড়ে যাওয়ার ভয় তাদের জন্মগতভাবেই রয়েছে। আশপাশে অভিভাবক ডাকলেও অধিকাংশ শিশু সেই কাচের ওপর এগোয় না। কারণ, শিশুরা জন্ম থেকেই উচ্চতা ও পড়ে যাওয়ার বিপদ আঁচ করতে পারে।
এটি শুধু মানুষের মধ্যেই নয়— ছোট বিড়াল, ছানা কুকুর বা মুরগির ছানারাও অনুরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ ধরনের উত্তরণমূলক সুরক্ষা-প্রক্রিয়া মানুষকে ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে সহায়তা করে।
তবে মজার বিষয় হলো, হামাগুড়ি দেওয়ার অভ্যাস তৈরি হওয়ার পর এই ভয় বাড়ে। যেসব শিশু এখনো হামাগুড়ি দিতে শেখেনি, তারা কাচের ওপর অনায়াসে চলে যায়। কিন্তু হামাগুড়ি শেখার পর শরীর ও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে এই ভয় ক্রমশ বাড়তে থাকে।
বিকট শব্দে ভয় বা ‘স্টার্টল রিফ্লেক্স’
একটি চট করে ফেলে দেওয়া বাসনের শব্দ, বাজ পড়া বা হর্ন— শিশুরা এসব শব্দে কেঁপে ওঠে। এটাই ‘স্টার্টল রিফ্লেক্স’। জন্মের পর থেকেই মানুষের স্নায়ু ব্যবস্থা বিকট শব্দকে বিপদের সংকেত হিসেবে ধরে নেয় এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখায়।
এমোরি ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্টিস্ট সেথ নরহোল্ম বলেন, ‘যদি শব্দ বিকট হয়, আপনি চমকে উঠবেনই। এটা মস্তিষ্কের একটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গগত প্রতিক্রিয়া।’
এমনকি নবজাতক শিশুদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, প্রেশার কুকারের শিস বা ব্লেন্ডারের শব্দ তাদের কাঁদিয়ে ফেলে। এটি নিছক ‘বাচ্চামি’ নয়, এটি আমাদের সুরক্ষামূলক উপাদান।
তাহলে সাপ, মাকড়সা বা অন্ধকারের ভয়?
এসব ভয়, কিন্তু জন্মগত নয়। এগুলো শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, পরিবেশ, কল্পনা এবং সামাজিক প্রভাব থেকে আসে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায় ১৯২০ সালের ‘লিটল আলবার্ট’ পরীক্ষা। যেখানে একটি শিশু ও একটি সাদা ইঁদুরকে এক সঙ্গে বিকট শব্দ শোনানো হয়। এরপর শিশুটি ইঁদুরকেই ভয় পেতে শুরু করে। এটাই ক্ল্যাসিক্যাল কন্ডিশনিং, যেখানে ভয় তৈরি হয় শেখার মাধ্যমে।
সাপ বা মাকড়সার প্রতি শিশুদের মনোযোগ কিছুটা বেশি হলেও, প্রকৃত ভয় তখনই আসে যখন তারা দেখে অন্যরা ভয় পাচ্ছে, বা কোনো নেতিবাচক অভিজ্ঞতা ঘটে। অন্ধকারের ভয়, মঞ্চে কথা বলার ভয় কিংবা ব্যর্থতার ভয়— সবই সামাজিকভাবে শেখা আচরণ।
সাইকোথেরাপিস্টরা বলেন, যেহেতু অধিকাংশ ভয় শিখন প্রক্রিয়ার ফল, তাই তা কাটানোও সম্ভব। ‘এক্সপোজার থেরাপি’ বা ধীরে ধীরে ভয়মুক্ত হওয়ার অনুশীলন এর একটি কার্যকর পদ্ধতি। আত্মবিশ্বাস ও সচেতনতা দিয়েও ভয়কে মোকাবিলা করা সম্ভব। যেমন বলা হয়, ‘আমরা শুধু দুটি ভয় নিয়ে জন্মাই। বাকি সব ভয় শেখা।’ এই উপলব্ধি আমাদের সাহস দেয়— যেহেতু আমাদের ভয় শিখন প্রক্রিয়ার ফল, আমরা তা ভুলতেও পারি।
তাই যখন কোনো অজানা পরিস্থিতিতে আপনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, তখন নিজেকে মনে করিয়ে দিন— এই ভয়টা আপনার জিনে ছিল না, আপনি হয়তো এটি শিখেছেন… এবং এখন আপনি চাইলে তা ভুলতেও পারেন।