শিরোনাম

মিশিগানের গবেষণাগারে টিকা উদ্ভাবনের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের মমতা

মিশিগানের গবেষণাগারে টিকা উদ্ভাবনের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের মমতা

ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রঘুরামপুরের এক প্রতিভাবান তরুণী এখন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় নিয়োজিত। তাঁর নাম মমতা আক্তার। তিনি বর্তমানে অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করছেন এবং গবেষণা করছেন প্রাণঘাতী গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টারোব্যাকটেরিয়াসি ফ্যামিলি দমনে কার্যকর ও টেকসই টিকা উদ্ভাবনে। পাশাপাশি তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েট টিচিং ও রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবেও কাজ করছেন। বিজ্ঞান ও মানবতার কল্যাণে এই নবীন গবেষকের নিরলস চেষ্টা আজ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্ব পাচ্ছে।

শিকড় থেকে শিখরে

শৈশব থেকেই প্রকৃতির বিভিন্ন রহস্য ঘিরে কৌতূহল ছিল মমতার। বাড়ির নানা উপকরণ মিশিয়ে রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া ঘটানোর চেষ্টা, টেলিভিশনে বিজ্ঞানের অনুষ্ঠান দেখে বিস্ময়ে মুগ্ধ হওয়া, আর বাবার কাছ থেকে শোনা বৈজ্ঞানিক যুগান্তকারী উদ্ভাবনের গল্প—এ সবই মমতার ভেতরে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার বীজ বপন করেছে।

নারী হওয়ার চ্যালেঞ্জ

গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের মতো মমতাও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন। টিউশন ফি, বইপত্র কেনা, ল্যাব ও লাইব্রেরির অভাব, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট-বিভ্রাট ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। তবে দমে যাননি তিনি। নিজে অধ্যয়ন পরিকল্পনা তৈরি করেছেন, বন্ধুদের সঙ্গে পড়াশোনার গ্রুপ তৈরি করেছেন, অনলাইন রিসোর্স কাজে লাগিয়েছেন। এমনকি সূর্যের আলোতে পড়াশোনা করে বিদ্যুৎ ঘাটতি পুষিয়ে নিয়েছেন।

ঢাবি থেকে মিশিগানে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকেই অর্গানিক কেমিস্ট্রির প্রতি মমতার গভীর আগ্রহ সৃষ্টি হয়। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তিনি অ্যাডভান্সড রিঅ্যাকশন মেকানিজম, ন্যাচারাল প্রোডাক্টস, মেডিসিনাল কেমিস্ট্রি, বায়ো-অর্গানিক কেমিস্ট্রি ও স্টেরিওকেমিস্ট্রির মতো বিষয় অধ্যয়ন করেন। তাঁর এম এস পর্যায়ের সুপারভাইজর অধ্যাপক ড. এস এম মিজানুর রহমান তাঁকে গবেষণার শৃঙ্খলা ও কৌতূহলের মধ্যে সুষম সমন্বয় শেখান। এই অভিজ্ঞতাই তাঁকে পিএইচডি গবেষণার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর সাহস জুগিয়েছে। ড. শুফেই হুয়াংয়ের অধীনে গবেষণা করছেন। এখানেই তিনি সিনথেটিক কেমিস্ট্রি (কার্বোহাইড্রেট) ও ভ্যাকসিন ডিজাইনের ব্যবহারিক দিক আয়ত্ত করেছেন।

ভ্যাকসিন গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা

মমতা এখন গবেষণা করছেন গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া দমনে সার্বজনীন ভ্যাকসিন তৈরির লক্ষ্যে। এই ব্যাকটেরিয়া রক্তজনিত সংক্রমণ, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, নিউমোনিয়া ও গ্যাস্ট্রোঅ্যান্টারাইটিসের জন্য দায়ী—বিশেষ করে যেসব প্রজাতি কারবাপেনেম অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। এই ‘সুপারবাগ’-এর বিরুদ্ধে কার্যকর টিকা তৈরি করা এখন বৈশ্বিক জরুরি চাহিদা। মমতা এমন একটি কার্যকর, সাশ্রয়ী ও স্কেলযোগ্য ভ্যাকসিন প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে কাজ করছেন, যা উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশ বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্যও সমানভাবে উপযোগী হবে। এই উদ্যোগ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘টিকা সবার জন্য’ দর্শনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক প্রকাশনা ও সম্মাননা

সম্প্রতি সায়েন্সডিরেক্ট প্ল্যাটফর্মের দ্য জার্নাল অব প্যাথলজি-রিসার্চ অ্যান্ড প্র্যাকটিসে তাঁর একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে তিনি সহলেখক। সেখানে ক্যানসার-সম্পৃক্ত ফাইব্রোব্লাস্টের (CAFs) ভূমিকা, ব্রেন মেটাস্টেসিস, ওষুধ প্রতিরোধ ও সম্ভাব্য থেরাপি নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মমতা আক্তার ২০১৭–১৮ অর্থ বছরে এম.এস. প্রোগ্রামে গবেষণার জন্য জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ পেয়েছেন। ২০২৪ সালের মার্চে তিনি মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ইমার্জেন্সি ফেলোশিপ ফান্ডিং পেয়েছেন, একই বছর ফেব্রুয়ারিতে অর্জন করেছেন বাংলাদেশ-সুইডেন ট্রাস্ট ফান্ড ট্রাভেল গ্রান্ট। তবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন—মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাপ্ত পূর্ণাঙ্গ তহবিলের পিএইচডি অফার।

নেতৃত্বে অনন্য

শুধু গবেষক নয়, মমতা নেতৃত্বেও এগিয়ে। তিনি বিএসিএবিএএনএর (বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড বায়োকেমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ইন নর্থ আমেরিকা) মিশিগান চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক। সংগঠনের সদস্যদের জন্য সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও নেটওয়ার্কিং ইভেন্টের আয়োজন করেন, যা একাডেমিক ও পেশাগত উন্নয়নে সহায়ক। এসব আয়োজন অনেক সময় চাকরি, ইন্টার্নশিপ ও পোস্টডক্টোরাল সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। তাঁর লক্ষ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, গবেষক এবং পেশাজীবীদের একাডেমিক ও পেশাগত উন্নয়নে সহায়তা করা। মমতা আক্তার বলেন, ‘গবেষণা অবকাঠামোয় বাড়তি বিনিয়োগ, সহযোগিতার সুযোগ সম্প্রসারণ এবং দক্ষ বিজ্ঞানীদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বাংলাদেশ ধাপে ধাপে একটি শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক ইকোসিস্টেমের ভিত্তি সৃষ্টি করছে। এই অগ্রগতি দেশটিকে বৈশ্বিক বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রায় অর্থবহ অবদান রাখার জন্য সুসজ্জিত করছে—বিশেষ করে এমন ক্ষেত্রগুলোতে যেখানে স্থানীয় জ্ঞান দিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যার উদ্ভাবনী সমাধান তৈরি সম্ভব।’ এ ছাড়াও সম্প্রতি তিনি মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির কেমিস্ট্রি গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশনের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট আউটরিচ অফিসার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।

তরুণদের জন্য পরামর্শ

নতুন গবেষক ও রসায়নে আগ্রহীদের জন্য মমতার পরামর্শ—‘বই মুখস্থ নয়, প্রতিক্রিয়ার পেছনে থাকা যুক্তি বুঝুন। হাতে-কলমে ল্যাব কাজ, ইন্টার্নশিপ ও গবেষণা আপনাকে বাস্তব বিজ্ঞানী হতে সাহায্য করবে। বৈজ্ঞানিক জার্নাল পড়ুন, উপস্থাপন দক্ষতা গড়ে তুলুন এবং প্রশ্ন করতে শিখুন। গবেষণার পথ কঠিন, কিন্তু জানার আগ্রহ ও সাহস থাকলে পরিবর্তন আনা সম্ভব।’ তাঁর স্বপ্ন—ফেডারেলভাবে অর্থায়িত একটি স্বতন্ত্র গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে সবার জন্য কার্যকর ও প্রবেশযোগ্য ভ্যাকসিন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হবে। এই লক্ষ্য শুধু বৈজ্ঞানিক নয়, একটি সমাজমুখী দর্শনের প্রতিফলন—যেখানে বিজ্ঞান মানবতার সেবায় নিয়োজিত।



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button