ইসরায়েল-ইরান সংকটে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে চীন


ইরানের তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্রে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর ইসরায়েল-ইরান দ্বন্দ্ব নতুন মোড় নিয়েছে। আর এই দ্বন্দ্বে চীনের অবস্থান হয়ে উঠছে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ। বেইজিং এই সংকটে এমন এক কৌশলী অবস্থান নিয়েছে যেখানে একদিকে ইরানের প্রতি কৌশলগত সমর্থন দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে ইসরায়েলের সঙ্গেও সম্পর্কের সেতু ধরে রাখা হচ্ছে। কারণ এই অঞ্চলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাণিজ্যপথ, শক্তি নিরাপত্তা এবং বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারে চীনাদের স্বার্থ।
প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর অধীনে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন বা মতামতের তোয়াক্কা না করেই ইরানে বারবার হামলা চালাচ্ছে। এই হামলাগুলোকে ‘পূর্বসতর্ক প্রতিরক্ষা’ হিসেবে দেখিয়ে ইসরায়েল দাবি করছে, এটি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি প্রতিরোধের জন্য। তবে বেইজিং এই যুক্তিকে ‘বিপজ্জনক প্রচারণা’ বলে আখ্যা দিয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে আরও বড় সংঘাতের বীজ বপন করতে পারে বলে সতর্ক করেছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বারবার ইরানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের নিন্দা করেছে এবং কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়ে বলেছে—সংঘাত শুধু আরও অস্থিরতাই সৃষ্টি করবে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশনেও চীন এই অবস্থান তুলে ধরে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা করেছে।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সম্প্রতি ইরান ও ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সঙ্গে পৃথকভাবে কথা বলেছেন। ইরানের সঙ্গে আলোচনায় ওয়াং ই ইসরায়েলের হামলাকে ‘অপরিণামদর্শী ও বিপজ্জনক’ উল্লেখ করে বলেছেন, পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে। আর ইসরায়েলকে দেওয়া বার্তায় তিনি আরও সংযত ভাষায় কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে এক বিশ্লেষণে চায়না-সিইই ইনস্টিটিউটের গবেষণা ফেলো ল্যাদিস্লাভ জেমানেক মত দিয়েছেন, চীনের অবস্থান স্পষ্ট। তারা ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির পক্ষে, তবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির বিপক্ষে। ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তিতে ইরানের সমর্থন এবং চুক্তি থেকে পরে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সরে যাওয়ার নিন্দা করে চীন এক বহু পাক্ষিক সমাধানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ২০২৪ সালের মার্চে বেইজিং চীন-ইরান-রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের একটি বৈঠকের আয়োজন করে, যেখানে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ জানানো হয়।
চীন ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক ২০২১ সালের ২৫-বছর মেয়াদি সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এতে বাণিজ্য, অবকাঠামো, শক্তি, প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা এবং শিক্ষা খাত অন্তর্ভুক্ত। ইরানের অপরিশোধিত তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করা যেমন চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ, তেমনি ইরানও চীনের কাছ থেকে উন্নত প্রযুক্তি ও কৌশলগত সহযোগিতা প্রত্যাশা করে।
তবে এই সম্পর্কেও সীমাবদ্ধতা আছে। যদি ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়, তাহলে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থে সরাসরি আঘাত হানবে। একইভাবে, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে এগোয়, তাহলে তা চীনের বহু পাক্ষিক ও আইনভিত্তিক অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে।
এই প্রেক্ষাপটে চীন একটি ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করছে—একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপমূলক নীতির বিরোধিতা করছে, অন্যদিকে সরাসরি সংঘাতে জড়াতে চাইছে না। ২০২৩ সালে চীনের মধ্যস্থতায় ইরান-সৌদি আরব সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। এর ফলে বিশ্বে চীনের কূটনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে। তারপরও ইরানের ওপর চীনের প্রভাব এখনো বলে মনে করেন ল্যাদিস্লাভ।
মে ২০২৪-এ ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর পর দেশটি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে কিছুটা নতুন সংলাপে আগ্রহী হয়েছে। তবে এই পরিবর্তনের মধ্যেই ইসরায়েল হিজবুল্লাহ ও হামাসকে লক্ষ্য করে অভিযান জোরদার করেছে, সিরিয়ায় অবস্থান বৃদ্ধি করেছে এবং ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সরাসরি আঘাত হেনেছে।
চীনের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—কীভাবে এই উত্তপ্ত অঞ্চলে তাদের স্বার্থ রক্ষা করে মধ্যপ্রাচ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি ভারসাম্য গড়ে তোলা যায়।