লাগাতার অসুস্থতার জন্য ঘন ঘন ছুটির আবেদন, দায়ী অফিসের এসি


গরমে স্বস্তির অপর নাম এসি। বাইরে যখন তাপমাত্রা অসহনীয়, তখন ঘরের মধ্যে শীতল বাতাস যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি। শুধু আরামই নয়, এসি ব্যবহারে ঘরের আর্দ্রতাও নিয়ন্ত্রিত থাকে।
তবে অনেকেই আছেন, যাঁরা গরমে কষ্ট করেও এসি ব্যবহার করেন না। তাঁদের বিশ্বাস, এসির কারণে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। এটি অনেকের কাছে অবাস্তব মনে হলেও এই ভয় পুরোপুরি অমূলক নয়।
কারণ, এসি সিস্টেম সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করা হলে তা জীবাণুর আখড়ায় পরিণত হতে পারে। ফলে এসি থেকে ছড়াতে পারে নানা ধরনের সংক্রামক রোগ—সাধারণ সর্দি থেকে শুরু করে নিউমোনিয়া পর্যন্ত।
বিজ্ঞানবিষয়ক ওয়েবসাইট সায়েন্স অ্যালার্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসি ব্যবহারে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। এই প্রতিবেদন লিখেছেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লেস্টারের সিনিয়র লেকচারার ও অণুজীববিজ্ঞানী প্রিমরোজ ফ্রিস্টোন।
‘সিক বিল্ডিং সিনড্রোম’
‘সিক বিল্ডিং সিনড্রোম’ এমন একটি অবস্থা, যা সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে এসি চালু থাকা ঘরে অবস্থান করলে দেখা দেয়। এর উপসর্গের মধ্যে রয়েছে মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, নাক বন্ধ বা সর্দি, কাশি, চামড়ায় চুলকানি বা র্যাশ, মনোযোগ কমে যাওয়া এবং অতিরিক্ত ক্লান্তি।
এই সমস্যা অফিসে কাজ করা মানুষের মধ্যে বেশি দেখা যায়, তবে হাসপাতালের মতো এসি-চালিত যে কোনো ভবনে দীর্ঘ সময় থাকলেও হতে পারে। এই উপসর্গগুলো নির্দিষ্ট ভবনে থাকলে বাড়ে, ভবন থেকে বের হলে কমে যায়।
২০২৩ সালে ভারতে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, এসি-যুক্ত অফিসে নিয়মিত দিনে ৬-৮ ঘণ্টা কাজ করা ২০০ জন কর্মীর মধ্যে এই উপসর্গের হার এসি ছাড়াই কাজ করা সমসংখ্যক ব্যক্তিদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। শুধু উপসর্গ নয়, গবেষণায় আরও দেখা গেছে, এসি অফিসে কাজ করা কর্মীদের ফুসফুসের কার্যক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম এবং তাঁদের কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতিও বেশি।
অন্য আরও গবেষণায় দেখা গেছে, এসি-চালিত পরিবেশে কাজ করা কর্মীদের মধ্যে সিক বিল্ডিং সিনড্রোমের প্রবণতা বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এর অন্যতম কারণ হলো বিকল এসি। যখন এসি সঠিকভাবে কাজ করে না, তখন তা যে ধুলোবালু, জীবাণু বা রাসায়নিক বাতাস থেকে আটকানোর কথা, সেগুলোই উল্টো বাতাসে ছড়িয়ে দেয়।
এ ছাড়া, এসির রক্ষণাবেক্ষণে ব্যবহৃত কিছু রাসায়নিক যেমন—বেনজিন, ফরমালডিহাইড বা টলুইন বাতাসে মিশে গিয়ে শ্বাসতন্ত্রে জ্বালা সৃষ্টি করতে পারে। সঠিকভাবে পরিষ্কার না করলে এসির মধ্যে জমে থাকা পানি ও ধুলোর কারণে সেখানে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক জন্ম নিতে পারে।
যেমন: লেজিওনেলা নিউমোফিলা (Legionella pneumophila) নামক ব্যাকটেরিয়া লেজিওনেলোসিস রোগের কারণ। এই ব্যাকটেরিয়া এসির পানিতে জন্মায় এবং সেখান থেকে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
এটি মূলত হোটেল, হাসপাতাল বা অফিসের মতো জায়গায় এসি বা পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ছড়ায়। এর উপসর্গ নিউমোনিয়ার মতো—কাশি, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, জ্বর ও শরীরব্যথা। রোগটি মারাত্মক এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
হাসপাতালের এসি সিস্টেমে অনেক সময় অ্যাসপারগিলাস (Aspergillus), পেনিসিলিয়াম (Penicillium), ক্লাডোসোপোরিয়াম (Cladosporium) ও রাইজোপাস (Rhizopus) জাতের ছত্রাক পাওয়া যায়। এই সংক্রমণ রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকা রোগী, অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা ব্যক্তি, ডায়ালাইসিস রোগী এবং অপরিণত শিশুদের জন্য মারাত্মক হতে পারে।
অ্যাসপারগিলিয়াসে ফুসফুস, মস্তিষ্ক, যকৃৎ, কিডনি, ত্বক ও ক্ষতস্থানে সংক্রমণ দেখা দেয়। উপসর্গের মধ্যে রয়েছে কাশি, শ্বাসকষ্ট, জ্বর, ওজন কমে যাওয়া এবং অতিরিক্ত ক্লান্তি।
এ ছাড়া এসি থেকে ছড়াতে পারে ভাইরাসও। এক গবেষণায় দেখা গেছে, চীনের একটি কিন্ডারগার্টেনে এসির মাধ্যমে নোরোভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে এবং ২০ শিশু পেটের অসুখে আক্রান্ত হয়।
সাধারণত নোরোভাইরাস সংক্রমণ স্পর্শ বা সংক্রামিত ব্যক্তির সংস্পর্শে ছড়ায়, তবে ওই ঘটনায় দেখা যায় এসির বাতাস থেকেই ভাইরাস ছড়িয়েছে।
আবার উল্টো দিকও আছে। ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা এসি সিস্টেম করোনাভাইরাসসহ অনেক ভাইরাসের উপস্থিতি বাতাসে কমিয়ে দিতে পারে বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
শুষ্কতা থেকে বাড়ে সংক্রমণের ঝুঁকি
এসি ব্যবহারে ঘরের বাতাসের আর্দ্রতা কমে যায়। শুষ্ক বাতাস নাক ও গলার মিউকাস ঝিল্লি শুকিয়ে দেয়, যা শরীরের প্রাকৃতিক জীবাণু প্রতিরোধব্যবস্থাকে দুর্বল করে। ফলে ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক সহজে শরীরে ঢুকে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
এসি মূলত বাতাসের ধুলোবালু, ছত্রাকের স্পোর, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস ছেঁকে দিয়ে পরিষ্কার বাতাস দেয়। তবে যদি এর ফিল্টার পুরোনো বা ময়লাযুক্ত হয় কিংবা নিয়মিত পরিষ্কার না করা হয়, তাহলে সেই সুরক্ষা আর কাজ করে না।
সুতরাং, এসি ব্যবহারে অসুবিধা নেই, বরং এটি স্বাস্থ্যকরও হতে পারে—যদি তা নিয়মিত পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। আর না হলে এই শীতল বাতাসই ডেকে আনতে পারে গুরুতর অসুস্থতা।
ক্রাইম জোন ২৪