উদ্ধার না করে জনতার হাতে ছেড়ে দিয়ে আসে পুলিশ


রংপুরের তারাগঞ্জে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে যখন বটতলায় একদফা পিটিয়ে বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে নেওয়া হয়, তখন তাদের উদ্ধারে সেখানে পুলিশ যায়। কিন্তু পুলিশের সামনেই তাদের মারধর শুরু করলে পুলিশ তাদের উদ্ধার না করে বাঁশিতে ফুঁ দিতে দিতে রূপলাল ও প্রদীপকে জনতার হাতে রেখে সরে যায়। এতে ক্ষুব্ধ লোকজন ফের নির্মম গণপিটুনি দেয়। তবে পুলিশ বলছে, সেখানে যাওয়া পুলিশ সদস্যরা থাকলে তাদেরও প্রাণ যেত। তাই তারা সরে এসেছে।
রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালের মৃত্যুর আগের শেষ দৃশ্যের ৫ মিনিট ২১ সেকেন্ডের ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, শনিবার রাত ৯টার দিকে বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে ভ্যানের ওপর শোয়া রূপলাল ও প্রদীপ লাল। ভ্যানটির তিন দিকে পুলিশ সদস্য। পুলিশ সদস্যরা হাত তুলে বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে লোকজনকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছে। এতেই হইচই বেড়ে যায়। পুলিশের সামনেই রূপলাল-প্রদীপকে মারধর শুরু করে জনতা। কিন্তু পুলিশ তাদের উদ্ধার না করে বাঁশি বাজাতে বাজাতে সেখান থেকে চলে যায়। শোয়া অবস্থায় রূপলাল উঠে বসতে চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেন না। অর্ধনগ্ন শরীরে লুঙ্গি ঠিক করার সময় চোখে-মুখে স্পষ্ট আতঙ্ক।
এ সময় মাথা উঠিয়ে পুলিশের দিকে তাকাতেই কালো গেঞ্জি পরা এক যুবক ঝাঁপিয়ে পড়ে বা হাত দিয়ে সজোরে রূপলালের মাথায় ঘুষি মারেন। রূপলাল লুটিয়ে পড়েন ভ্যানের ওপর। সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম সারির লোকজন জুতা, রশি, লাঠি, রড যা পেয়েছে তাই দিয়ে আঘাত শুরু করে। প্রদীপ লাল ভ্যান থেকে মাটিতে পড়ে গেলে সেখানেও থামেনি হামলা। কেউ জুতা দিয়ে, কেউ গাছের ডাল দিয়ে, কেউ ভ্যানের প্যাডেল দিয়ে পেটাচ্ছে। এ দৃশ্য মোবাইল ফোনের ফ্লাসলাইট জ্বালিয়ে ধারণ করছিলেন অনেকেই।
ওই ভিডিওতে দেখা যায়, প্রদীপ লাল ভ্যান থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে সেখানে তাঁকে লাথি মারতে থাকেন এবং রূপলালকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় ভ্যানসহ প্রদীপ লালের ওপর উল্টে দেওয়া হয়। এতে দুজনেই ভ্যানের নিচে চাপা পড়েন। এরপর তাদের ওপরে থাকা ভ্যানটিতে চাপ দেন। এ সময় বাঁশির শব্দ শোনা গেলেও কোনো পুলিশ সদস্য দেখা যায়নি। কয়েকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘এ মরে নাই এ্যালাও। দে দে চাপা দে। আরও দে।’
একপর্যায়ে চাপা পড়া ভ্যানটি কয়েকজন যুবক-তরুণ তাদের ওপর থেকে সরিয়ে নেন এবং রশি, জুতা, গাছের ডাল, ভ্যানের প্যাডেল দিয়ে আবারও প্রহার করতে থাকেন। তখন নিস্তেজ ছিলেন রূপলাল ও প্রদীপ। তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে হলুদ, কালো, লাল গেঞ্জি পরা চার-পাঁচজন তরুণ-যুবক রূপলালের পিঠে লাথি মারতে থাকেন।
এ সময় পাশ থেকে কয়েকজন বলতে থাকেন, ‘দে দে, আরও দে।’ প্রদীপ লালকে দেখিয়ে আঙুল উঁচিয়ে একজন বলতে থাকেন, ‘এ ওইটাকও দে। মার। নড়ি (গাছের ডাল) পাছাত ঢুকি দেও।’ বলে উল্লাস করতে থাকেন। এ কথা শুনে হলুদ গেঞ্জি পরা এক তরুণ গাছের ডাল দিয়ে আরও মারতে থাকেন। হলুদ গেঞ্জি পরা দুই তরুণ পিঠের ওপর একাধিকবার লাথি মেরে যান। অ্যাস-সাদা গেঞ্জি পরা আরেকজন গলায় পা তুলে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। উত্তেজিত জনতা উল্লাসে চিৎকার করে—‘পুলিশ পালাইছে!’ বলে উল্লাস করতে থাকে।
বুড়িরহাট বাজারের ব্যবসায়ী খোকন মিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যখন স্কুল মাঠে রূপলাল ও প্রদীপকে চোর হিসেবে আনা হয়। তার কিছুক্ষণ পরই দুটি পুলিশের গাড়ি যায় সেখানে। অল্প কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর তারা ফিরে যায় এবং প্রায় এক ঘণ্টা পর সেনাবাহিনীসহ পুলিশের তিনটি গাড়ি সেখানে যায়।’ একই কথা জানিয়েছেন সয়ার ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আব্দুল হামিদ। প্রত্যক্ষদর্শী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ আসি বাঁশি ফুকায় কিন্তু জনগণ সারে না। আবার তারা চলি যায়।’
পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থল থেকে রূপলাল ও প্রদীপ লালকে উদ্ধার করে তারাগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক রূপলালকে মৃত ঘোষণা করে। প্রদীপ লালকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির জন্য পাঠায়। সেখানে প্রদীপ লাল রোববার ভোর ৪টায় মারা যান।
এ ঘটনায় বাদী হয়ে পরদিন রোববার দুপুরে রূপলাল রায়ের স্ত্রী ভারতী রানী ৫০০ থেকে ৭০০ জনকে আসামি করে তারাগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ময়নাতদন্ত শেষে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে রূপলালের লাশ বাড়িতে এলে ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কে তাঁর লাশ রেখে অবরোধ করেন এলাকাবাসী। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের আল্টিমেটাম দেন তাঁরা। এ ঘটনায় পুলিশ ওই দিন রাতেই চারজনকে গ্রেপ্তার করে।
তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ ফারুক বলেন, ‘ঘটনাস্থলে উত্তেজিত হাজার হাজার মানুষ ছিল। সেখানে চারজন পুলিশ ছিল। তারা তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু পেছন থেকে যখন তাদের ধাক্কাধাক্কি ঘুষাঘুষি শুরু করছে। তখন তারা জীবনে ভয়ে সরে এসেছে। না হলে পুলিশ চারজনও মারা যেত। পুলিশের করার কিছু ছিল না। ভিডিও দেখে প্রকৃত দোষীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’
ক্রাইম জোন ২৪