পাহাড়সম প্রত্যাশার পথে ভুল আর বাধা


দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান হয়েছিল গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনে। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশ চালানোর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সমাজে আর মানুষের মনে জেগেছিল পাহাড়সম প্রত্যাশা। সেই সরকারের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। মানুষ হিসাব করছে—কী চেয়েছিলাম, কী পেলাম; কেন পেলাম না।
দায়িত্ব নিয়েই সরকার ঘোষণা দিয়েছিল তাদের প্রধান অগ্রাধিকার সংস্কার আর জুলাই অভ্যুত্থানের গণহত্যাকারীদের বিচার। সংস্কার-বিচারের দুটি বিষয়ই এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু তার অগ্রগতি সন্তুষ্ট করতে পারছে না মানুষকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংকটকালীন পরিস্থিতিতে সরকার গঠনের পর কত দিন এই সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে হবে, সেই মেয়াদ নির্ধারিত না থাকায় কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে সময়ে সময়ে নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেয়েছে তারা। সমালোচনার মুখে অনেক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয়েছে। আবার রাজনৈতিকভাবেও বারবার বাধার মুখে পড়তে হয়েছে তাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রত্যাশার পরিমাণটা ছিল পাহাড়সম। কিন্তু সে অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত কাজ করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের অনেকেই জুলাইয়ের চেতনা ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন; যার প্রতিফলন হিসেবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়নি। দাবি আদায়ে এক বছর পরেও জুলাই যোদ্ধারা রাস্তায় আন্দোলন করছেন।
জুলাই আন্দোলনে গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারে ধীরগতি নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে স্বজনদের। বর্তমান সরকারের মেয়াদেই এই গণহত্যার বিচার শেষ করে তা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। সরকারও ধারণা দিয়েছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ৫-৬টি মামলার রায় হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
অভ্যুত্থানে শহীদ নাঈমা সুলতানার মা আইনুন নাহার বলেন, ‘এখনো খুনিদের বিচার হচ্ছে না কেন? ইউনূস স্যার তো বলেছিলেন, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে। এখন পর্যন্ত বিচারের কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। সন্তানের হত্যাকারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা মুক্ত। আমরা এখনো শোকে বিধ্বস্ত। আমি চোখ বন্ধ করলেই সেদিনের ঘটনা চোখে ভাসে। সন্তান হত্যার বিচার চাই।’
গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চারটি মামলার বিচার শুরু হয়েছে, ২৭টি অনুসন্ধান পর্যায়ে আছে, ১৬টির অভিযোগপত্র হয়েছে।
সরকার এক বছরে জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি মত দিয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, মানুষ ভালো অনেক পরিবর্তন আশা করলেও তা হয়নি। জনপ্রশাসনকে পুরোপুরি দুর্বল করে ফেলেছে। আগে ছিল রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির জনপ্রশাসন। আর এখন ভীত, অযোগ্য, অদক্ষ জনপ্রশাসন। ব্যক্তিগত পছন্দের লোকদের ঢোকানো হয়েছে। সরকার আর্থিক খাতে কিছুটা ভালো করেছে। আইনশৃঙ্খলা, জনগণের সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রগুলোয় চরম ব্যর্থ। এর কারণ হলো সরকার প্রথমে সঠিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে যখন যেটা খুশি সেটাই করেছে, এতে করে ভুল হয়েছে। অনেক সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নিতে পারেনি। মবের কারণে দক্ষ ও সাহসী কর্মকর্তারাও ভালো সিদ্ধান্ত নিতেও ভয় পাচ্ছেন।
কোন পথে সংস্কার
সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন, প্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সমন্বয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে সরকার। এই কমিশনের মেয়াদ ১৪ আগস্ট শেষ হওয়ার কথা। তবে দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ প্রথম পর্যায়ে এক মাস, পরে আরও বাড়াতে যাচ্ছে সরকার। এই সময়ের মধ্যে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করা হবে।
ঐকমত্য কমিশন গঠনের পরে পুলিশ সংস্কার ছাড়া বাকি পাঁচটি কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ৩২টি দল ও জোটের কাছে ১৬৬টি প্রস্তাব পাঠানো হয়; যার ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ৪৫ অধিবেশনের সংলাপে ৬২টি প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়। দ্বিতীয় ধাপে ২৩ দিনের সংলাপে ১৯টি বিষয়ে সমাধান আসে।
ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো বাস্তবায়নে জুলাই সনদের খসড়া করে তা রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঠিয়েছে কমিশন। এই সনদে সই করলে ঐকমত্যে আসা সংস্কার প্রস্তাবগুলো পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে দলগুলোকে।
এ বিষয়ে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো একমত হলেও জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ সংলাপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ দল বর্তমান সরকারের অধীনেই সংস্কারের আইনি ভিত্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। এরপর কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে তারা রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করবে।
সংস্কার কমিশনগুলোর স্বল্প মেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য ১২১টি সুপারিশের মধ্যে ১৬টি বাস্তবায়ন হয়েছে, ৮৫টি বাস্তবায়নাধীন, ১০টির আংশিক বাস্তবায়ন এবং অন্য ১০টি বাস্তবায়নযোগ্য কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে বলে গতকাল উপদেষ্টা পরিষদকে অবহিত করা হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। তবে জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের পথ কোনো না কোনোভাবে বের করতে হবে। সেটি নিয়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করব। তার আগে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসব। এসব আলোচনার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের পথ বের করতে হবে, এটাই আমাদের লক্ষ্য।’
প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
অন্তর্বর্তী সরকার গত এক বছরে জাতির প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। গতকাল গুলশানের নিজ বাড়িতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, সরকারের কাছে জাতির প্রত্যাশা অনেক ছিল, তারা তা পূরণ করতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেশি ব্যর্থতা ছিল।
সংস্কার বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা বলেন, সংবিধান সংশোধন ছাড়া যেসব সংস্কার এখনই বাস্তবায়ন করা সম্ভব, আগামী নির্বাচনের আগে সেসব সংস্কার কার্যকরে বিএনপির কোনো আপত্তি নেই।
জুলাই ঘোষণাপত্রে জুলাই সনদের বিষয় না থাকায় হতাশা প্রকাশ করেছে জামায়াত। দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের গত বুধবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জুলাই ঘোষণায় কখন, কীভাবে সেসব কার্যকর করা হবে, তা উল্লেখ না করে ঘোষণাকে গুরুত্বহীন করা হয়েছে। পরবর্তী সরকারের হাতে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়ায় হাজার হাজার মানুষের আত্মত্যাগ, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত জুলাই চেতনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।
সংস্কার প্রস্তাবের অনেক বিষয় বাস্তবায়নে কমিশন একটি বড় দলের দিকে ঝুঁকেছে বলে অভিযোগ করেছেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, প্রস্তাব বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও সরকার একটি বড় দলের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। তাদের চাওয়া-পাওয়া অনুযায়ীই বিষয়টি এগোচ্ছে। ফলে সংস্কারের এই উদ্যোগ নব্বইয়ের তিন জোটের রূপরেখার মতো কাগুজে বাঘে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
আর সরকারের অদক্ষতার কারণে ত্যাগ অনুযায়ী গত এক বছরে অর্জন হয়নি বলে মনে করেন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের মাধ্যমে বড় অর্জনের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তার জন্য দেশের জনগণ সর্বোচ্চ ত্যাগ করেছে। কিন্তু সরকারের সমস্যা হচ্ছে সংবিধান সংস্কার ও সংশোধনের পার্থক্য বোঝে না। সে জন্য সংশোধনের জায়গাটাকে সংস্কার ধরে নিয়ে সম্ভাবনাটাকে নষ্ট করা হয়েছে। তবে সরকারের হাতে সময় আছে, আন্তরিক হলে কাটিয়ে উঠতে পারবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রত্যাশার পরিমাণটা ছিল পাহাড়সম। কিন্তু সে অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত কাজ করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের অনেকেই জুলাইয়ের চেতনা ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যার প্রতিফলন হিসেবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়নি। দাবি আদায়ে এক বছর পরেও জুলাই যোদ্ধারা রাস্তায় আন্দোলন করছে।