শিরোনাম

চীন-রাশিয়ার আগেই চাঁদে পারমাণবিক চুল্লি বসাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

চীন-রাশিয়ার আগেই চাঁদে পারমাণবিক চুল্লি বসাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

চাঁদের মাটিতে ২০৩০ সালের মধ্যে পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে নাসা। এই পদক্ষেপ চাঁদে মানুষের স্থায়ী বসতি গড়ার উচ্চাভিলাষের অংশ। কারণ, মানুষের বসবাসের জন্য সেখানে নিরবচ্ছিন্ন শক্তি সরবরাহ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকো জানিয়েছে, এই উদ্যোগ মূলত চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে চলমান মহাকাশ প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার কৌশলের অংশ।

চীনা ও রাশিয়ার সমজাতীয় পরিকল্পনার বিষয় উল্লেখ করে নাসার ভারপ্রাপ্ত প্রধান শন ডাফি বলেন, ওই দুই দেশ ‘সম্ভবত চাঁদে কিপ-আউট জোন ঘোষণা করতে পারে।’ অর্থাৎ, চীন ও রাশিয়ার মতো দেশগুলো চাঁদে এমন কোনো এলাকা ঘোষণা করতে পারে, যেখানে অন্য দেশগুলোকে প্রবেশ বা কাজ করতে দেওয়া হবে না।

তবে সম্প্রতি নাসার বাজেট কেটে দেওয়া এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে লক্ষ্য অর্জন ও সময়সীমার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কিছু বিজ্ঞানীর মতে, পরিকল্পনাগুলো জিওপলিটিক্যাল প্রেক্ষাপটে পরিচালিত হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ভারত, জাপানসহ অনেক দেশ চাঁদের পৃষ্ঠে অনুসন্ধান অভিযান ত্বরান্বিত করছে। এর মধ্যে কিছু দেশ চাঁদে স্থায়ী মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন সচিব শন ডাফিকে নাসার অস্থায়ী প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ডাফি নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘ভবিষ্যতের চন্দ্র অর্থনীতি, মঙ্গলগ্রহে উচ্চ শক্তি উৎপাদন এবং মহাকাশে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা শক্তিশালী করতে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি দ্রুত এগিয়ে নেওয়া অপরিহার্য।’

ডাফি বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর কাছে কমপক্ষে ১০০ কিলোওয়াট ক্ষমতা উৎপাদনযোগ্য পারমাণবিক চুল্লি তৈরির প্রস্তাব আহ্বান করেছেন। তবে এটি তুলনামূলকভাবে ছোট। কারণ, একটি সাধারণ স্থলভিত্তিক বায়ু টারবাইনই ২-৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।

চাঁদের বিদ্যুৎ শক্তির উৎস হিসেবে পারমাণবিক চুল্লি বসানোর ধারণা নতুন নয়। ২০২২ সালে নাসা তিনটি সংস্থাকে পারমাণবিক চুল্লির ডিজাইন করার জন্য প্রতি সংস্থাকে ৫০ লাখ ডলার চুক্তি দিয়েছিল।

চলতি বছরের মে মাসে চীন ও রাশিয়া ঘোষণা করেছে, তারা ২০৩৫ সালের মধ্যে চাঁদে স্বয়ংক্রিয় নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে।

অনেক বিজ্ঞানী একমত যে চাঁদে ধারাবাহিক শক্তি সরবরাহের জন্য এটি সবচেয়ে কার্যকর বা একমাত্র উপায় হতে পারে।

সারি ইউনিভার্সিটির সিনিয়র লেকচারার ড. সঙউ লিম বলেন, ‘একটি ছোট দল নিয়ে ছোট স্থাপন করলেও সেই বসতিতে মেগাওয়াট পর্যায়ের বিদ্যুৎশক্তির প্রয়োজন হবে। শুধু সৌর প্যানেল ও ব্যাটারি দিয়ে এই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়।’

সঙউ লিম আরও যোগ করেন, ‘নিউক্লিয়ার শক্তি কেবল ইচ্ছাকৃত নয়, এটি অবশ্যম্ভাবী।’

ল্যানকাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-বিজ্ঞান ও গ্রহবিদ্যা প্রফেসর লায়নেল উইলসন মনে করেন, ‘যদি যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করা হয়, তবে ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে পারমাণবিক চুল্লি স্থাপন প্রযুক্তিগতভাবে সম্ভব। তিনি উল্লেখ করেন যে ছোট পারমাণবিক চুল্লি ডিজাইন ইতিমধ্যেই রয়েছে। তবে নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও কিছু প্রশ্ন রয়েছে।

ওপেন ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞ ড. সিমিয়ন বারবার বলেন, ‘পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল দিয়ে তেজস্ক্রিয় পদার্থ উৎক্ষেপণ নিরাপত্তার জন্য চ্যালেঞ্জ। এর জন্য বিশেষ লাইসেন্স প্রয়োজন। তবে এটি অতিক্রমযোগ্য।’

ডাফির নির্দেশনা আসে নাসায় সাম্প্রতিক উত্থান-পতনের পরিপ্রেক্ষিতে। ২০২৬ সালে ট্রাম্প প্রশাসন নাসার বাজেট ২৪ শতাংশ হ্রাসের ঘোষণা দিয়েছিল। এতে মঙ্গলের নমুনা ফিরিয়ে আনাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের বাজেট কাটা পড়েছে।

বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এই ঘোষণাটি আন্তর্জাতিক চাঁদের প্রতিযোগিতায় রাজনৈতিক প্রভাবের দ্বারা প্রণোদিত।

ড. বারবার বলেন, ‘আমরা যেন আবার পুরোনো মহাকাশ দৌড়ের সময়ে ফিরে যাচ্ছি, যা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিছুটা হতাশাজনক।’

২০২০ সালে সাতটি দেশ চাঁদে সহযোগিতা-সম্পর্কিত নীতিমালা স্থাপনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তিতে দেশের বিভিন্ন কার্যক্রম ও সম্পদের চারপাশে সুরক্ষা অঞ্চলের নিয়ম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

ড. বারবার আরও বলেন, ‘যদি আপনি চাঁদে পারমাণবিক চুক্তি বা কোনো বেস স্থাপন করেন, আপনি তখন আপনার আশপাশে সুরক্ষা অঞ্চল দাবি করতে পারেন। কারণ, সেখানে আপনার যন্ত্রপাতি রয়েছে। চাঁদে মানুষের ব্যবহারের জন্য পারমাণবিক চুক্তি স্থাপনের আগে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।’

নাসার আর্টেমিস ৩ মিশনের মাধ্যমে ২০২৭ সালের মধ্যে চাঁদে আবার মানুষ পাঠাতে চায় নাসা। তবে বাজেট ও অন্যান্য কারণে এই মিশনের কাজ ঝুলে পড়েছে।

এদিকে গত মে মাসে চাঁদে যৌথভাবে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়তে চুক্তি করেছে রাশিয়া ও চীন। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবহার করা হবে তাদের পরিকল্পিত ‘ইন্টারন্যাশনাল লুনার রিসার্চ স্টেশন’ বা আইএলআরএস চালাতে। দুই দেশের মধ্যে সম্প্রতি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে—বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০৩৬ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button