শিরোনাম

ইকুয়েডরের প্রাকৃতিক স্বর্গ হঠাৎ অস্তিত্ব সংকটে, নেপথ্যে বিপুল সোনা

ইকুয়েডরের প্রাকৃতিক স্বর্গ হঠাৎ অস্তিত্ব সংকটে, নেপথ্যে বিপুল সোনা

আন্দিজ পর্বতের প্রায় ৩ হাজার মিটার উচ্চতায় বিস্তৃত ইকুয়েডরের মাকিজো দেল কাআস অঞ্চলটি একটি বিশেষ ধরনের পরিবেশ—যাকে বলা হয় প্যারামো। প্রাকৃতিক স্পঞ্জের মতো কাজ করে এই অঞ্চলটি। মেঘ থেকে টেনে আনে আর্দ্রতা, আর জল জোগায় ছয়টি বড় নদীকে। এই পানিই স্থানীয় পাহাড়ি গ্রাম, শহর এমনকি আমাজন অববাহিকায়ও পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

এখানকার বাঁকানো পলাইলেপিস গাছেই বাস করে বিপন্ন পার্বত্য ট্যাপির, দেখা মেলে দুর্লভ হামিংবার্ডের। আর এই ভূপৃষ্ঠের নিচেই রয়েছে বিলিয়ন ডলারের স্বর্ণ, রুপা ও তামার খনি! এই খনিকে ঘিরেই অঞ্চলটি যেন সংঘাতের নতুন ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—২০১৩ সালে ইউনেসকো কাআস-কে জীবমণ্ডল সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, তা খনন কোম্পানিগুলোর থাবা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। ইতিমধ্যে তারা ১ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে খনিজ অনুসন্ধানের জন্য ছাড়পত্র পেয়েছে। এর মধ্যে ১৫ হাজার হেক্টরই রয়েছে প্যারামোর মধ্যে। পরিবেশবিদদের মতে, সংরক্ষিত এলাকায় খনি কোম্পানিগুলোকে খোঁড়াখুঁড়ির অনুমতি দেওয়ার কোনো যৌক্তিক বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নাই, এটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

২০২৪ সালের ২৩ জুন কানাডাভিত্তিক ‘ডান্ডি প্রিসিয়াস মেটালস’ কোম্পানি ‘লোমা লারগা’ খনির পরিবেশগত লাইসেন্স পায়। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ কর্মসংস্থান ও ৪৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা আসে। কোম্পানির দাবি, তারা সব নিয়ম অনুসরণ করেছে এবং প্রকল্পটি হবে নিরাপদ। তবে স্থানীয় মানুষ ও পরিবেশ আন্দোলনকারীরা বলছেন, প্রকল্পটি ব্যাপক পরিবেশগত ক্ষতির কারণ হবে এবং প্রাকৃতিক জল সরবরাহ ব্যবস্থাটি দূষিত হবে। এর ফলে লাখ লাখ মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়বে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও আন্দোলনকারীরা দাবি করেছেন, তাঁদের মতামত ছাড়াই প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং তাঁরা নজরদারি ও ভয়ভীতির শিকার হচ্ছেন। কাআসের কাউন্সিলর গুসমান ও অ্যাকটিভিস্ট অ্যাসথের রেমাচে অভিযোগ করেছেন, অজ্ঞাত ব্যক্তিরা তাঁদের অনুসরণ করে, ছবি তোলে—যা স্পষ্টতই ভয় দেখানোর কৌশল। তবে ডান্ডির পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানানো হয়েছে, তাদের নিরাপত্তারক্ষীরা মানবাধিকারের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং তারা নিয়ম মেনেই কাজ করেন।

জেন্টিয়েনেলা হারকুলাস ফুলটি প্যারামোর টিউলিপ হিসেবে পরিচিত। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান
জেন্টিয়েনেলা হারকুলাস ফুলটি প্যারামোর টিউলিপ হিসেবে পরিচিত। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

পরিবেশবিদ হেরপেটোলজিস্ট হুয়ান কার্লোস সানচেজ বলেন, ‘এখানে এমন অনেক উভচর প্রাণী আছে যা শুধুমাত্র কাআস অঞ্চলেই পাওয়া যায়। আমরা প্রতি বছরই নতুন নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করছি। খনন কার্যক্রম এগুলোর অস্তিত্ব বিলীন করে দেবে।’ এমনকি স্থানীয় পানি সংস্থার গবেষণাও বলছে, ডান্ডির পরিবেশ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে অসংখ্য ভুল ও ত্রুটি রয়েছে। তাদের মতে, প্রকল্পটি জনস্বাস্থ্য, প্রাকৃতিক জলাধার ও জীববৈচিত্র্যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করবে।

তবে ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট ডেনিয়েল নোবোয়া এই খনি প্রকল্পকে এক নতুন যুগের সূচনা হিসেবে দেখছেন। তিনি খনির সময়সীমা ২৫ বছর বাড়িয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক খনি সম্মেলনে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে অংশ নিয়েছেন। এমনকি সম্প্রতি পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর গত জুলাইয়ে তাঁর প্রশাসন পরিবেশ মন্ত্রণালয় বিলুপ্ত করে এর দায়িত্ব খনি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করেছে। বিশ্লেষকেরা এই পদক্ষেপটিকে পরিবেশ রক্ষার শেষ চেষ্টাকে নির্মূল করার সঙ্গে তুলনা করেছেন।

সরকার বলছে, জনগণের মতামত ও ভোট নিয়েই এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, স্থানীয়দের অনেকেই জানতেন না কোনো ভোট হয়েছে। অনেকে বলেছেন, সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে একটি অনির্ধারিত দিনে ভোট আয়োজনের চেষ্টা হয়েছিল। পরে জনরোষে তা ব্যর্থ হয়।

জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ইকুয়েডর সরকারকে সতর্ক করেছে। এই সরকার দেশটির উত্তর-পশ্চিমে খনি বিরোধী বিক্ষোভ দমন করতে সেনাবাহিনী পর্যন্ত পাঠিয়েছিল। এতে ৩৬ জন আহত হন এবং ১০০ জনের বেশি ব্যক্তিকে সন্ত্রাসবাদে অভিযুক্ত করা হয়।

প্যারোমাকে বাঁচাতে যারা লড়াই করছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হাইড্রোলজি প্রকৌশলী সান্দ্রা বারোস। তিনি বলেন, ‘এখানে আমরা শুধু প্রকৃতি রক্ষা করছি না, আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করছি। এটা জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন।’

পরিবেশ কর্মী কার্লোস কাস্ত্রোর ভাষায়, ‘এটাই শেষ যুদ্ধ—এখানে হেরে গেলে, বাকিগুলো ডোমিনোর মতো ভেঙে পড়বে।’



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button