শিরোনাম

সেদিন বিজয় দেখেছিল জনতা

সেদিন বিজয় দেখেছিল জনতা

পরপর তিনটি নির্বাচনে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে মানুষ। দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসন, চাকরিতে বৈষম্য, সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যাংক খাতে লুটপাট, বিরোধী মত দমনে গুম, খুন ও নির্যাতনে ক্ষুব্ধ ছিল জনগণ। সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে জুলাইয়ে ছাত্র- জনতার আন্দোলনে। ৩৬ দিনের এই আন্দোলন চুরমার করে দেয় শেখ হাসিনার সব দম্ভ। গত বছরের ৫ আগস্ট পতন ঘটে তাঁর স্বৈরশাসনের। সেই ঐতিহাসিক জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি আজ।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে গতকাল সোমবার পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বাণীতে বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দিন আজ। এক বছর আগে এই দিনে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পূর্ণতা পায়, দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্ত হয় প্রিয় স্বদেশ। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ, যাদের মুখবন্ধ আন্দোলনের ফসল আমাদের এই ঐতিহাসিক অর্জন, তাদের সবাইকে আমি এই দিনে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।’

জুলাই আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি দিয়ে। ঘটনাক্রমে সেটি আর কোটা সংস্কার আন্দোলনে আটকে থাকেনি। আন্দোলন দমাতে সরকার কঠোরতার পথ বেছে নিলে একের পর এক লাশ পড়তে থাকে পুলিশের গুলিতে। এতে তীব্র হয়ে ওঠে আন্দোলন। ছাত্রদের সঙ্গে রাজপথে নেমে আসে সাধারণ মানুষ।

২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট এক রায়ে সরকারি চাকরিতে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেন। ওই রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ বিষয়ে গোঁ ধরে সরকারও জানায়, চাকরিতে কোটা নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে আদালতে।

২০২৪ সালের ১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে চাকরিতে কোটা সংশোধনের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। প্রথম দুই দিন শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন তেমন নজরে না এলেও ৩ জুলাই ঢাকায় সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন তাঁরা। বাড়তে থাকে আন্দোলনের তীব্রতা। সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারাও জুলাইয়ের শুরু থেকে আন্দোলনে ছিলেন।

৭ জুলাই শিক্ষার্থীদের বাংলা ব্লকেড কর্মসূচিতে অচল হয়ে পড়ে পুরো ঢাকা। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ঢাকার বাইরেও। ১০ জুলাই আপিল বিভাগ কোটার বিষয়ে চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরতে বলেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা নির্বাহী বিভাগে বিষয়টির স্থায়ী সমাধান করে আইন করার দাবি জানান। তবে এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার।

১১ জুলাই পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। ১৪ জুলাই চীন সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিরা কোটা পাবে না তো কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?’ তাঁর এ বক্তব্যে ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন পায় নতুন মাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বের হয়, ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার, রাজাকার’; ‘কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’। ১৫ জুলাই সকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঔদ্ধত্যের জবাব দেবে ছাত্রলীগ। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকারদলীয় নেতা-কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ১৬ জুলাই ঢাকায় দুজন, চট্টগ্রামে তিনজন এবং রংপুরে মারা যান আবু সাঈদ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে ১৮ জুলাইয়ের এইচএসসি পরীক্ষাও স্থগিত করে সরকার।

আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকলে ১৮ জুলাই শিক্ষার্থীদের আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেন আইনমন্ত্রী। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করে ১৮ জুলাই থেকে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে সরকার। বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট। এ দিন পর্যন্ত সারা দেশে মৃত্যুর সংখ্যা পৌঁছায় ৫৩ জনে। নাহিদ ইসলামসহ আন্দোলনে নেতৃত্বে দেওয়া ছয় সমন্বয়ককে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়াসহ ৯ দফা দাবিতে এ দিন রাতে আবার ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

পরিস্থিতি সামাল দিতে ২১ থেকে ২৩ জুলাই সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। ২২ জুলাই কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণাসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় বাতিল করেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে মেধায় ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গণার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করে দেন আপিল বিভাগ। উচ্চ আদালত থেকে শিক্ষার্থীদের পক্ষে রায় আসায় ২২ জুলাই শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে যারা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে, তাদের ছাড়া হবে না। আদালতের রায়ের আলোকে ২৩ জুলাই কোটা সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। কয়েক জেলায় কারফিউ শিথিল করা হয়। ২৪ থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত সীমিতভাবে অফিস চলে। ৩১ জুলাই থেকে স্বাভাবিক সময় ধরে সরকারি-বেসরকারি অফিস চলে।

কোটা পদ্ধতি সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারির পর আন্দোলনে জড়িতদের সারা দেশে গ্রেপ্তার করা হয়। শীর্ষ সমন্বয়কেরা ডিবি হেফাজতে থাকায় তখন আন্দোলন থমকে ছিল। ২৫ জুলাই মিরপুর-১০ নম্বরে মেট্রো রেলস্টেশন পরিদর্শনে গিয়ে কেঁদে ফেলেন শেখ হাসিনা। সরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের বিচার দেশবাসীর কাছে চান তিনি।

ডিবি হেফাজতে থাকা ছয়জন সমন্বয়কের একটি ভিডিও বার্তায় ২৮ জুলাই আন্দোলন-কর্মসূচি প্রত্যাহারের কথা জানানো হয়। তবে ডিবি কার্যালয়ে তাদের কাছ থেকে জোর করে বিবৃতি আদায় করা হয়েছে বলে দাবি করেন সমন্বয়কদের আরেক অংশ। ২৯ জুলাই তাঁরা সারা দেশে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ ঘোষণা করেন।

এর মধ্যে ২৯ জুলাই রাতে ১৪ দলের সঙ্গে বৈঠকে জমায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। অন্যদিকে কোটা আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে ৩০ জুলাই ফেসবুক প্রোফাইল লাল রং করেন শিক্ষার্থীরা। ৩১ জুলাই মার্চ ফর জাস্টিস পদযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা করেন তাঁরা। শিক্ষার্থীদের এই কর্মসূচিতে ব্যাপক চড়াও হয় পুলিশ। আন্দোলন আবার মাত্রা পায়। ১ আগস্ট জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এ দিন ডিবি হেফাজত থেকে মুক্তি পান সমন্বয়কেরা। কিন্তু গ্রেপ্তারকৃত সবাইকে মুক্ত না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে ঘোষণা দেন তাঁরা।

২ আগস্ট সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই কর্মসূচি পালন করতে গেলে সরকার সমর্থকদের সঙ্গে তাদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়, আবারও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নির্বিচার গুলি ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং ৯ দফা দাবিতে ৩ আগস্ট সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়। সেদিন দুপুরের আগেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এখান থেকে সরকারের পদত্যাগের এক দফা ঘোষণা করে নাহিদ ইসলাম অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এ দিন শিক্ষার্থীদের আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেন শেখ হাসিনা। সহিংসতায় জড়িত নয় এমন শিক্ষার্থীদের মুক্তির নির্দেশ দেয় সরকার। রংপুরে আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় পুলিশের দুই সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়। সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম বাতিল করা হয়। এ দিন ঢাকায় সেনাসদরে অফিসার্স অ্যাড্রেস (সেনা কর্মকর্তাদের মতবিনিময়) হয়। ওই মতবিনিময়ে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বিভিন্ন পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাদের বক্তব্য শোনেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষে ৪ আগস্ট পুরো দেশ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এমন পরিস্থিতে দুই দিন পর ৬ আগস্ট মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সরকার কারফিউ জারি করলে মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট করা হয়। ৫ আগস্ট ঢাকার অলিগলি, রাজপথ—সবকিছু ছাত্র-জনতার দখলে চলে যায়। এ দিন দুপুর ১২টায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর থেকে জানানো হয়, দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বেলা ২টায় জাতির উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তখনই শেখ হাসিনার পতনের খবর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় বিজয় উল্লাস। পুরো ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। বেলা ৩টা ৫০ মিনিটে সেনাসদর দপ্তরে দেওয়া ভাষণে সেনাবাহিনীর প্রধান জানান, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। তাঁর এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে এক দাম্ভিক স্বৈরশাসকের পতনের খবর জেনে যায় বিশ্ব।



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button