জুলাই আন্দোলনের এক বছর: অভ্যুত্থান, অস্থিরতা এবং নির্বাচন


আজ পয়লা জুলাই। বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন শুরুর এক বছর পূর্তি হলো। কয়েক সপ্তাহব্যাপী এই আন্দোলন শেষ হয়েছিল শেখ হাসিনা নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে। হাসিনা ১৫ বছর ধরে কঠোর হস্তে দেশ শাসন করেছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত সর্বশেষ নেতাও তিনি।
প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এখন এক ধরনের রাজনৈতিক অচলাবস্থায় রয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৬ সালে। হাসিনার পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এখন দেশ পরিচালনা করছে। বছরখানেক আগে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নামার পর থেকে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে ঘটে যাওয়া পাঁচটি প্রধান ঘটনা নিচে তুলে ধরা হলো—
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য বিদ্যমান কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে। অভিযোগ, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে মূলত হাসিনার অনুগতদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এর কয়েক মাস আগেই এক বিতর্কিত নির্বাচনে হাসিনা পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
হাসিনার শাসনামলে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের গণহারে আটক ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও অন্তর্ভুক্ত। জুলাই মাসের মাঝামাঝি পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনায় প্রাণঘাতী সহিংসতা আরও তীব্র হয়।
বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ এবং এই বিক্ষোভের কারণে শিল্পটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কারফিউ জারি, সেনা মোতায়েন ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার পরও সংঘর্ষ বাড়তে থাকে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এই অস্থিরতায় প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হন।
হাজার হাজার বিক্ষোভকারী হাসিনার সরকারি বাসভবন—যেটিকে তিনি প্রাসাদের মতো ব্যবহার করতেন—দখল করে নেয়, রাস্তায় নেমে আসা লাখ লাখ মানুষ উল্লাস করতে থাকে। এমনকি সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান ও ট্যাংকের ওপর উঠে অনেকে নৃত্যও করে। হাসিনা হেলিকপ্টারে করে তাঁর প্রতিবেশী মিত্র দেশ ভারতে চলে যান। এরপর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে বলে ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এবং সেনাবাহিনী এখনো একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস শিক্ষার্থীদের অনুরোধে বাংলাদেশে ফিরে এসে ‘প্রধান উপদেষ্টা’ হিসেবে সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
ইউনূস বলেন, উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি ‘সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া’ একটি সরকারি প্রশাসন ব্যবস্থা পেয়েছেন। ৮৫ বছর বয়সী এই ক্ষুদ্রঋণের পথিকৃৎ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজানোর জন্য একটি উচ্চাভিলাষী কর্মসূচি শুরু করেন। তাঁর মতে স্বৈরাচারী শাসনের প্রত্যাবর্তন রোধের জন্য এটি অপরিহার্য।
অন্তর্বর্তী সরকার সতর্ক করে বলেছে যে, তীব্র রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াই অর্জিত অগ্রগতিকে বিপন্ন করতে পারে। ড. ইউনূসের সরকার ‘বৃহত্তর ঐক্যের’ আহ্বান জানিয়েছে এবং সংস্কার বাস্তবায়ন করা না গেলে ‘স্বৈরাচারী শাসনের প্রত্যাবর্তনের’ ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনার আওয়ামী লীগকে কার্যত নিষিদ্ধ করেছে। বিক্ষোভকারীদের ওপর মারাত্মক দমন-পীড়নের ঘটনায় দলটির নেতাদের বিচারের ফলাফলের অপেক্ষায় আছে দেশ।
শক্তিশালী বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) আগামী নির্বাচনে এগিয়ে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। দলটি চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে। সেনাপ্রধানও বিএনপির এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছেন।
ইউনূস বলেছেন, নির্বাচনের আগে তাঁর সংস্কার বাস্তবায়নের দায়িত্ব রয়েছে এবং তিনি ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে ভোটগ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁর বিচার শুরু হয়েছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল ‘সুপরিকল্পিত হামলার’ অভিযোগ আনা হয়েছে। ৭৭ বছর বয়সী এই নেত্রী ভারতে স্বেচ্ছা নির্বাসনে রয়েছেন এবং অভিযোগগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
হাসিনার সরকারের জ্যেষ্ঠ নেতা ও কর্মকর্তাদের বিচার ক্ষমতা দখলের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের প্রধান দাবি। যাদের বিচার চলছে তাদের মধ্যে সাবেক পুলিশ প্রধান ও প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও রয়েছেন।
রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিএনপির তীব্র চাপের মুখে ইউনূস নির্বাচনের সময়সীমা এগিয়ে এপ্রিলের শুরুতে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, ভোটগ্রহণের পর তিনি পদত্যাগ করবেন। বিএনপি বলছে, তারা রমজান মাসের আগে নির্বাচন চায়। রমজান শুরু হবে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের ১৭ তারিখের দিকে। অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, সংস্কার ও বিচারকার্যে ‘উল্লেখযোগ্য’ অগ্রগতি হলে তারা ভোট এগিয়ে আনতে পারে।