শিরোনাম

হাজতকক্ষ যেন ফোন কলের দোকান

হাজতকক্ষ যেন ফোন কলের দোকান

চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের হাজতখানা যেন ফোনে কথা বলার একটি দোকান। এখানে আসামিরা স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে অবাধে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন। পুলিশই টাকার বিনিময়ে দাগি সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে বিভিন্ন মামলার আসামির হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জেলখানায় কিংবা হাজতখানায় আসামিদের মোবাইল ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। হাজতখানার বিধি অনুযায়ী, সাধারণ আসামিরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা, সেটা তো তাঁরা পাচ্ছেন না; বরং সেখানে টাকা দেওয়া আসামিদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এগুলো জেলখানায় যেমন, হাজতখানায়ও তেমন। বিশেষ করে শীর্ষ সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি ও বড় বড় অপরাধী মোবাইল ফোনে কথা বলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সুবিধা নিচ্ছে। এই ধরনের কর্মকাণ্ড আদালতের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় হুমকি।’

গত ১৮ মে সরেজমিনে দেখা যায়, আদালতের হাজতখানার ‘ভিআইপি কক্ষে’ মোবাইলে কথা বলছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যাসহ ২১ মামলার আসামি চসিকের সাবেক কাউন্সিলর ও উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জহুরুল আলম জসিম। তিনি কারও সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেন। ওই কক্ষে থাকা আরও এক আসামিকে একইভাবে মোবাইল ফোনে কথা বলতে দেখা যায়। কক্ষটির এককোনায় রাখা ছিল আরও তিনটি স্মার্টফোন ও একটি ফিচার ফোন। এ চারটি ফোন আসামিদের কথা বলার জন্য পুলিশ রেখেছে বলে জানা গেছে।

এর একটি ভিডিও চিত্র আজকের পত্রিকার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর আগস্টের পর পলাতক থাকা জসিমকে গ্রেপ্তারের জন্য চট্টগ্রামের আকবরশাহ এলাকায় কয়েক দফা অভিযান চালিয়েও পায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত ৫ মার্চ জসিমকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাঁকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এর পর থেকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন জহুরুল আলম জসিম।

চট্টগ্রামে পাহাড় পরিদর্শনকালে পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের গাড়িবহরে হামলার মামলারও আসামি এই জসিম।

২২ মে দুপুরে মো. হাসান নামের সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত এক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীও আদালতের হাজতখানায় একইভাবে মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন। নগরের বায়েজিদ, চান্দগাঁও, বাকলিয়ায় জোড়া খুনসহ চাঞ্চল্যকর কয়েকটি হত্যা মামলার আসামিকে এর আগে মামলায় হাজিরা দিতে চট্টগ্রাম কারগার থেকে আদালতে আনা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, হাজতখানায় ভিআইপি কক্ষে অবস্থানকালে পুলিশের উপস্থিতিতে আসামি হাসান মোবাইলে তাঁর সহযোগীসহ বিভিন্নজনের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলেছেন। ওই দিন হাসানের সঙ্গে কয়েকজন যুবক দেখা করতে আসেন বলে সূত্র জানিয়েছে।

পরদিন ২৩ মে চট্টগ্রামে পতেঙ্গা সৈকত এলাকায় ঘুরতে আসা শীর্ষ সন্ত্রাসী ঢাকাইয়া আকবরকে একদল দুর্বৃত্ত গুলি করে চলে যায়। পরে চমেক হাসপাতালে আকবর মারা যান। এই হত্যাকাণ্ড হাসানের পরিকল্পনা ও নির্দেশে ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়।

জানা যায়, আসামি হাসানের প্রতিপক্ষ ছিলেন ঢাকাইয়া আকবর। সম্প্রতি বাকলিয়ায় জোড়া খুনসহ একাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের আগে ও পরে হাসানের সম্পৃক্ততা নিয়ে ফেসবুকে ছবিযুক্ত একাধিক পোস্ট ও লাইভে এসে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়েছিলেন ঢাকাইয়া আকবর।

ঢাকাইয়া আকবর খুনের ঘটনায় পতেঙ্গা থানায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলায় ১১ জন এজাহারনামীয় আসামির মধ্যে ১০ জনই হাসানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। এসব সহযোগীর সঙ্গে মিলে আগে একাধিক হত্যাকাণ্ড চালানোর অভিযোগে হাসানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

হাসান চট্টগ্রামে আট খুনের ঘটনায় আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও শিবিরের ক্যাডার বিদেশে পলাতক সাজ্জাদ আলী খানের অনুসারী ও বর্তমানে চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দী আরেক আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী।

আদালতের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের হাজতখানায় চারটি কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে একটি কক্ষ নারী আসামিদের জন্য। অন্য তিনটির মধ্যে দুটি সাধারণ আসামিদের এবং একটি কক্ষ থাকে ভিআইপি আসামিদের জন্য।

আদালতে বিভিন্ন মামলায় হাজিরা দিতে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে আনা ভিআইপি আসামি, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, প্রভাবশালী, দাগি সন্ত্রাসী হাজতখানার এই ভিআইপি কক্ষে অবস্থান করেন। মূলত যাঁরা টাকা দেন, তাঁদের এই কক্ষে আরাম-আয়েশে রাখা হয়। সেই সঙ্গে আসামিদের মোবাইল ফোনে কথা বলার সুযোগ করে দেয় পুলিশ।

হাজতখানায় নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে, এমন আইনজীবীর সহকারী জানান, এটা হাজতখানার মধ্যে একটা ওপেন সিক্রেট। চাহিদামতো ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে হাজার টাকা খরচ করলেই আসামিরা মোবাইলে কথা বলতে পারছেন। পুলিশের পাশাপাশি আসামিদের স্বজনদের সরবরাহ করা মোবাইলেও আসামিরা কথা বলে থাকেন। এখান থেকে বিভিন্ন সময় আসামিরা বাদীকে হুমকি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ তৎপরতা চালাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাজতখানার বারান্দায় সোজাসুজি সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলেও আসামি রাখার সেলগুলোতে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। সুযোগ পেয়ে হাজতখানায় বেআইনি কাজে জড়াচ্ছে পুলিশ ও আসামিরা।

জানতে চাইলে আদালতের হাজতখানার দায়িত্বে থাকা নগর পুলিশের পরিদর্শক শাহীনূর আলম বলেন, ‘আসামিরা অনেক সময় জরুরি প্রয়োজনে দু-এক সেকেন্ড কথা চলতে চায়। মানবিক কারণে তখন বিষয়টি বিবেচনা করে আমাদের পুলিশ সদস্যরা দাঁড়িয়ে থেকে তাঁদের মোবাইলে কয়েক সেকেন্ড কথা বলার সুযোগ দেন। তবে এটা সব সময় না। এটার বাইরে হাজতখানায় মোবাইলে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও আমাদের ভুলত্রুটি থাকতে পারে, এটা খোঁজ নিয়ে দেখব।’

পরিদর্শক শাহীনূর আলমের ভাষ্য, হাজতখানায় ভিআইপি আসামিদের জন্য কোনো কক্ষ নেই। মূলত ওই কক্ষে আসামিরা নামাজ পড়েন। কেউ বই পড়েন এবং বিশ্রাম নিয়ে থাকেন।



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button