রোহিঙ্গাদের লড়াইয়ে ম্লান হচ্ছে প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা


মিয়ানমারের রাখাইনে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে বিভিন্ন রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী লড়াই শুরু করেছে। এই লড়াইয়ে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশের কক্সবাজারে বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারা। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সেখানে পাঠানো হচ্ছে। সংস্থাটি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, এতে রাখাইনে আন্তসাম্প্রদায়িক সম্পর্ক বিনষ্ট হতে পারে।
গতকাল বুধবার এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। গতকাল তাদের ওয়েবসাইটে প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে হটিয়ে রাখাইন রাজ্যের উত্তরের বড় একটি অংশ দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি (এএ)। মিয়ানমারের এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উত্থানের পর রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াই করতে তারা বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির থেকে সদস্য সংগ্রহের গতি বাড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা মুসলিমেরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু। এই রাজ্যের বড় অংশ এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। আর তাদের প্রধান সমর্থক রাখাইনে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী। তবে তাদের বিরুদ্ধে এখন কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এর সুযোগ নিচ্ছে এবং ধর্মীয় ভাষা ব্যবহার করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দলে টেনে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার।
ক্রাইসিস গ্রুপ বলছে, আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জয়ের সম্ভাবনা খুবই কম। ফলে এই লড়াইয়ের কারণে মিয়ানমারের এই অঞ্চলে আন্তসাম্প্রদায়িক সম্পর্ক বিনষ্ট হতে পারে। এতে করে রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে দুই পক্ষ থেকে চাপে পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ থেকে রাখাইনে তাদের ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে আসবে বলে মনে করছে ক্রাইসিস গ্রুপ।
ক্রাইসিস গ্রুপের এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারের উদ্দেশে বেশ কিছু পরামর্শ তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উচিত এই মুহূর্তে সীমান্ত এলাকায় ত্রাণ সরবরাহ বাড়ানো এবং রাখাইনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলা।
একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব যাতে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে কমে যায়, সেই ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে তারা। এ দিকে আরাকান আর্মির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, তারা রাখাইনে যেসব সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করছে তাদের সবার দেখভাল করে।
কথা রাখেনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো
‘বাংলাদেশ/মিয়ানমার: রোহিঙ্গা বিদ্রোহের ঝুঁকি’ শীর্ষক ক্রাইসিস গ্রুপের এ প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো রাখাইনে নিজেদের রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি বলে দাবি করে। বাংলাদেশে শরণার্থীশিবিরগুলোতে তারা কয়েক বছর ধরে রক্তক্ষয়ী অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে। তবে রাখাইনে আরাকান আর্মির উত্থানের পর শরণার্থীশিবিরে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পারস্পরিক দখলদারির সংঘাত দ্রুত কম গেছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে তারা একটি সমঝোতায় পৌঁছায়; একসঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন তাদের লক্ষ্য আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করা, এ জন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো দলে সদস্য বাড়াচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের সরকার আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের যে সীমান্ত রয়েছে, তার পুরোটাই এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। রাখাইনে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ক্রমবর্ধমান হামলা আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের এই আলোচনাকে দুর্বল করে দিতে পারে। শুধু তা-ই নয়, বরং মিয়ানমারে রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব আরও প্রবল হতে পারে; যা প্রায় ১০ লাখ শরণার্থীর প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।