এজাহারের ভুয়া কপি দেখিয়ে চাঁদা আদায় বিএনপি নেতার


আওয়ামী সরকারের পতনের পর রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডি এম জিয়াউর রহমান দলটির ২০০ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করতে একটি এজাহার প্রস্তুত করেছিলেন। তবে তা থানায় দেওয়ার আগেই পাঠান আওয়ামী লীগের লোকজনের কাছে এবং মামলার ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদকের মাধ্যমে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বরাবর দেওয়া এক লিখিত অভিযোগ সূত্রে এসব জানা গেছে।
শুধু এটাই নয়; জিয়ার বিরুদ্ধে কেন্দ্রে পাঠানো ওই অভিযোগপত্রে স্থানীয় নেতারা উল্লেখ করেন, টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগের লোকদের তিনি রাতারাতি বিএনপির লোক বানান। উপজেলা পরিষদের সামনে চেয়ার-টেবিল পেতে অস্থায়ী দপ্তরও বানিয়েছেন। কথায় কথায় পুলিশকে হুমকিও দেন। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জিয়া।
জানা গেছে, ২ জুন বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরে এই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অভিযোগটি দিয়েছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও নরদাশ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন; উপজেলা বিএনপির সদস্য ও গোবিন্দপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান; উপজেলা বিএনপির সদস্য ও গণিপুর ইউপির চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান এবং শুভডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন।
পুলিশের দুই জিডি
কেন্দ্রে পাঠানো অভিযোগে বলা হয়, ৫ আগস্টের পর অফিসকক্ষে প্রবেশ করে জিয়া বাগমারার হাটগাঙ্গোপাড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ আকরাম হোসেনকে গালাগাল এবং পেটানোর হুমকি দেন। পরে জিয়ার বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন আকরাম।
এ ছাড়া গত ১৬ মে ডি এম জিয়ার মদদে তাঁর ছোট ভাই ডি এম সাফির নেতৃত্বে তাঁদের অনুসারীরা রক্ষিতপাড়া গ্রামের বিল দখলকে কেন্দ্র করে পাঁচটি বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করেন। এ বিষয়ে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে গেলে উল্টো পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সিদ্দিককে গুলি করে মেরে ফেলা এবং বোমা মেরে ফাঁড়ি উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। এ ঘটনায় পুলিশ একটি জিডি করেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাগমারা থানার ওসি তৌহিদুল ইসলাম প্রথমে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। পরে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘চাকরি করি তো ভাই। এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না। সমস্যা হবে।’
আরও যত অভিযোগ
সূত্র জানিয়েছে, জিয়া পশ্চিম নাককাটি, বিল কালাই ও বিল মালোনিতে তাঁর লোকজন দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বিল মালোনি দখল করেন। এ ঘটনার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে অভিযোগ হয়। এ ছাড়া অনেক আওয়ামী লীগ লোকজনের পুকুরে তাঁর লোকজন দ্বারা জটিলতা তৈরি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
দলীয় অভিযোগে বলা হয়, বাড়িতে নৌকা মার্কার নির্বাচনী অফিস বানিয়ে ভোট করেছিলেন নরদাশ ইউপির সদস্য রফিকুল ইসলাম। ৫ আগস্টের পরে টাকার বিনিময়ে তাঁকে বিএনপি বানিয়ে সার্বক্ষণিক সঙ্গে নিয়ে চলাফেরা করছেন জিয়া। হাটগাঙ্গোপাড়া ফিলিং স্টেশনের মালিক আওয়ামী লীগ নেতা সবুর উদ্দিনকেও টাকার বিনিময়ে বিএনপিতে নিয়েছেন ডি এম জিয়া। গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের জেএমবি ক্যাডারখ্যাত মামুন মুহুরি, শুভডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শাহরিয়ার আলী, ফরিদ উদ্দিন, বাসুপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা তহিদুল ইসলামকেও টাকার বিনিময়ে বিএনপিতে নিয়েছেন। তাঁরা এখন ডি এম জিয়ার সার্বক্ষণিক সঙ্গী।
২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ সালের বাগমারার সাবেক এমপি এনামুল হকের সঙ্গে ডি এম জিয়া সব সময় আঁতাত করে থেকেছেন। তার যথেষ্ট ছবি এবং ভিডিও ফেসবুকে দেখা যায়। এমনকি পার্শ্ববর্তী উপজেলা পবা-মোহনপুর আসনের ২০১৪, ২০১৮ সালের সাবেক এমপি আয়েন উদ্দিন এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের সাবেক এমপি আসাদুজ্জামান আসাদের সঙ্গেও তিনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, ডি এম জিয়াউর রহমান ২০১৪ সালে উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অংশগ্রহণ করলে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় কমিটি। ২০১৭ সালে জেলা বিএনপির তৎকালীন সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন তপু তাঁর বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করে উপজেলা বিএনপির সভাপতি করে পুরস্কৃত করেন।
অভিযোগকারীদের একজন উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক মোশারফ হোসেন বলেন, ‘জিয়াউর রহমান সব সময়ই দলের পরিপন্থী কাজ করে যাচ্ছেন। এসব তো আমরা পছন্দ করি না। তাই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কেন্দ্রে লিখিত অভিযোগ করেছি।’
যা বলছেন জিয়া ও জেলা বিএনপি
উপজেলা পরিষদে চেয়ার-টেবিল পেতে অস্থায়ী দপ্তর বানানোর কথা স্বীকার করলেও বাকি অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন জিয়া। তিনি বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। আমার কোনো চেম্বার নাই। উপজেলার গেটে একটা ক্যানটিন আছে। আমি যেহেতু উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলাম, গেলে তারা কয়েকটা চেয়ার-টেবিল বের করে দেয়। আমি লোকজন নিয়ে সেখানে বসি।’
এজাহার প্রস্তুত করে টাকা আদায়ের বিষয়ে জিয়া বলেন, ‘৫ আগস্টের পরে তো দূরের কথা, গত ২০ বছরেও আমি কোনো এজাহার লিখিনি। থানায় অভিযোগ দিইনি।’
এসব বিষয়ে জানতে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদকে ফোন করা হলে তাঁর নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। সদস্যসচিব বিশ্বনাথ সরকার বলেন, ‘তাঁরা অভিযোগটা দিতে ভুল করেছে। সরাসরি কেন্দ্রে না পাঠিয়ে আমাদের কাছে দিতে পারত। তাহলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারতাম। কারণ, কেন্দ্রে অভিযোগ গেলেও সেটা আমাদেরই দেখতে বলা হয়। ডি এম জিয়ার বিরুদ্ধে এ রকম কোনো অভিযোগ গেছে কি না, তা জানি না। কারণ, কেন্দ্র আমাদের কিছু জানায়নি এখনো।’