শিরোনাম

দেশের মানুষ বলে, টাকা দাও ভোট দেব: যুক্তরাজ্যে ড. ইউনূস

দেশের মানুষ বলে, টাকা দাও ভোট দেব: যুক্তরাজ্যে ড. ইউনূস

ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: আপনাদের সবাইকে চ্যাথ্যাম হাউসে স্বাগত জানাচ্ছি। বিশেষভাবে স্বাগত জানাই, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে।

আমি ব্রনওয়েন ম্যাডক্স, চ্যাথ্যাম হাউসের পরিচালক। দর্শকদের ভিড় এবং আগ্রহ দেখে বোঝা যায়, ইউনূস সাহেবকে আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার খুব একটা প্রয়োজন নেই।

আপনারা জানেন, অধ্যাপক ইউনূস ‘গ্রামীণ ব্যাংকে’র প্রতিষ্ঠাতা। এই উদ্যোগের জন্য তিনি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। এরপর তিনি ৫০টির বেশি সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগ গড়ে তুলেছেন।

২০২৪ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও দীর্ঘদিনের শাসনামলের অবসানের পর আন্দোলনকারীরা তাঁকে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানায়। তিনি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং এখন বাংলাদেশের নতুন যাত্রার নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

আজকের আলোচনায় থাকছে নির্বাচন, গণমাধ্যম, অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, যুব উন্নয়ন, রোহিঙ্গা সংকট ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি— সবকিছু।

এই অনুষ্ঠানটি চ্যাথাম হাউস রুল বা চ্যাথাম হাউসের নীতিসংশ্লিষ্ট নয়। এটি সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে এবং সম্পূর্ণ অন-দ্য-রেকর্ড।

অধ্যাপক ইউনূস: আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ।

আমি বহুবার লন্ডনে এসেছি—বিভিন্ন ভূমিকায়। প্রথম এসেছিলাম ১৯৫৫ সালে, কানাডায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্কাউট জাম্বুরি শেষে। সেবার বিবিসির একটি বাংলা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে দুই গিনি সম্মানী পেয়েছিলাম—এখনো মনে আছে!

এরপর বহুবার এসেছি মাইক্রোক্রেডিট, সামাজিক ব্যবসা, তরুণদের নেতৃত্ব এবং আমার তিনটি শূন্যের দর্শন প্রচারে— শূন্য কার্বন নির্গমন, শূন্য সম্পদের কেন্দ্রীকরণ, শূন্য বেকারত্ব।

আমার বিশ্বাস, বর্তমান সভ্যতা ভুল পথে হাঁটছে—এটি আত্মবিনাশী। আমাদের টিকে থাকতে হলে, নতুন এক সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে এই তিনটি শূন্যের ভিত্তিতে।

এটি নিছক তাত্ত্বিক নয়, আমার জীবনের অভিজ্ঞতা ও বাস্তব কাজের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।

তবে এবার এসেছি এক ভিন্ন ভূমিকায়— সরকারপ্রধান হিসেবে। এটি আমার জীবনে এক অনাকাঙ্ক্ষিত অধ্যায়, যা আমি কখনো ভাবিনি। কিন্তু এখন সেই দায়িত্বেই আছি। তাই আজকের আলোচনা সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই হবে।

ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: ধন্যবাদ। আমরা জানি, আপনি ব্রিটেনের রাজা চার্লসের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন পরিবেশ ও সামাজিক উদ্যোগ নিয়ে। আবার বর্তমান দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেও সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আপনার বৈঠক হয়েছে।

চলুন, আমরা মূল আলোচনায় যাই, শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্বাচন। আপনি সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৫ সালের এপ্রিলে। কিন্তু সেনাবাহিনী ও কিছু রাজনৈতিক মহল চায়, নির্বাচন হোক চলতি বছরের মধ্যেই। অন্যদিকে, আপনার সরকার আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না, যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা শুরু হয়েছে। আপনার জবাব কী?

অধ্যাপক ইউনূস: আমি বারবার বলেছি— এটি হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন। সময় উপযোগী নির্বাচন। দীর্ঘ ১৭ বছর পর আমরা একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নির্বাচন করতে যাচ্ছি। এটি শুধু রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি এক ঐতিহাসিক সুযোগ।

ধরুন, এক তরুণ ১৭ বছর আগে ভোটার হতে পেরেছে, কিন্তু কখনো ভোট দিতে পারেনি। এমন হাজারো তরুণ এখন প্রথমবারের মতো ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবে। তারা বলছে, ‘এবার আমার সিদ্ধান্তই মুখ্য। আমার ভোটেই গঠিত হবে বাংলাদেশ।’

এই তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগাতে চাই আমরা। নির্বাচন শুধু সরকার গঠনের জন্য নয়, এটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার রেফারেন্ডাম। তরুণদের রক্ত আর আত্মত্যাগে আমরা ঋণী। আমরা সেই আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে চাই।

এই নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপিত হচ্ছে তিনটি মূল স্তম্ভে—

১. সংস্থার সংস্কার: যেসব প্রতিষ্ঠান সংকট তৈরি করেছে, সেগুলোর কাঠামোগত রূপান্তর দরকার। আমরা এর জন্য আলাদা আলাদা কমিশন গঠন করেছি— সংবিধান, সংসদ, নির্বাচন ব্যবস্থা, সিভিল সার্ভিসসহ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের জন্য। কমিশনগুলোর সুপারিশ হাতে এসেছে। এগুলো কেবল সামান্য সংস্কার নয়—গভীর পরিবর্তনের প্রস্তাব রয়েছে।

২. আলোচনা ও ঐকমত্য: সংস্কারের আগে দরকার সর্বদলীয় ঐকমত্য। এ জন্যই আমরা গঠন করেছি ‘ঐকমত্য কমিশন’। এই কমিশনের কাজ হলো— বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে বাস্তবসম্মত ও গ্রহণযোগ্য সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করা। হয়তো বিশ্বের কোথাও এ ধরনের উদ্যোগ খুব একটা দেখা যায় না। তবে বাংলাদেশের মতো জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

৩. নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণ: আমরা চাই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই গণতন্ত্র। অবশ্যই এটি সহজ নয়—বাংলাদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলা কঠিন কাজ। কিন্তু আমরা যদি সত্যিই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে এটাই পথ।

ব্রনউইন ম্যাডক্স: আমি বলতে চাই, এটি অনেক রাজনীতিকের জন্যই কঠিন বিষয়— এটি আমি কোনো রকম ঠাট্টা করে বলছি না। কেউ কেউ বলতেই পারেন, ‘আপনার এই প্রক্রিয়া তো গণতন্ত্রের মৌলিক উপাদানকেই বাদ দিচ্ছে। ভোটারদের বিশ্বাস করুন। জনগণকে স্বাধীনভাবে সব দল ও মতবাদের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দিন। তাদের বিচার–বুদ্ধির ওপর আস্থা রাখুন। তাঁরা নিজেরাই ঠিক পথটি খুঁজে নেবেন।

অধ্যাপক ইউনূস: আমি নিজেও চাই— সবকিছু যদি কেবল ভোটারদের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়া যেত! কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যদি রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক কাঠামোর জটিল বিষয়গুলো— দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ কিংবা অনুপাতভিত্তিক ভোটব্যবস্থার মতো ধারণা পুরোপুরি বুঝত! উল্টো তাঁরা বলবে, ‘আমরা এসব বুঝি না! আমি তোমাকে ভোট দেব, কয় টাকা দেবে?’— সহজ ভাষায় বললে বিষয়টি তাই— ‘তুমি টাকা দাও, আমি ভোট দেব।’ দেশে ভোটের চর্চা সেটাই।

আমরা বলেছি, আমরা সেই চর্চায় ফিরতে চাই না। তাই আমরা ভিন্ন পথে হেঁটেছি। আমরা সবকিছু জনসম্মুখে করছি। এই সব বিতর্ক, সুপারিশ, সংলাপ প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। মানুষ নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে—কী আলোচনা হচ্ছে, কী ঝুঁকি আছে, কী সম্ভাবনা আছে।

আমাদের লক্ষ্য একদম স্পষ্ট— যেসব সংস্কার প্রস্তাবে সকল রাজনৈতিক দলের সম্মতি রয়েছে, সেগুলো একত্র করে একটি ঐক্যমতের দলিল তৈরি করা। আমরা এটির নাম দিয়েছি ‘জুলাই সনদ’।

এই সনদ আগামী মাসে জাতির সামনে উপস্থাপন করব। এটি যখন চূড়ান্ত হবে এবং সব রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করবে, তখন আমরা এটিকে উদযাপন করব একটি জাতীয় ঐকমত্য হিসেবে। এর ভিত্তিতেই পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

তাই, নির্বাচন আসলে আমাদের বৃহত্তর কর্মসূচির একটি অংশ। সেই বৃহৎ কর্মসূচির প্রথম স্তম্ভ হলো—সংস্কার। আমাদের সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে পুরোনো প্রতিষ্ঠানগুলোই। তাই প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।

আমরা প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পৃথক কমিশন গঠন করেছি। তারা যে সুপারিশগুলো করেছে, তা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন, কিছুটা নাটকীয়ও। নির্বাচন কমিশন, সংসদ, সংবিধান, প্রশাসন— সবকিছু নিয়ে আমরা গভীরভাবে কাজ করছি।

পরবর্তী ধাপ হলো ঐক্যমতের ভিত্তি তৈরি। আমরা সব দলকে নিয়ে ঐকমত্য গঠনে কমিশন তৈরি করেছি। এরকম কিছুর নাম হয়তো আপনি এর আগে শুনেননি। এই কমিশনের কাজ হলো— সব দলের অংশগ্রহণে প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে সেই সংস্কারগুলো খুঁজে বের করা, যেগুলো নিয়ে সমঝোতা সম্ভব।

হ্যাঁ, এটা সহজ নয়— বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে ঐক্য তৈরি করা কঠিন কাজ। কিন্তু আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্থিতিশীল গণতন্ত্র গড়তে চাই, তাহলে এটাই প্রয়োজন।

ব্রনউইন ম্যাডক্স: আমি বিচারপ্রক্রিয়ার বিষয়ে পরে আসছি, তবে ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে একটু কথা আছে। সমালোচকদের মতে, এই সনদ নিয়ে ঐকমত্য বাধ্যতামূলক করে আপনি কার্যত কিছু রাজনৈতিক দলকে—যেমন আওয়ামী লীগকে— গোটা প্রক্রিয়া থেকেই বাদ দিয়ে দিচ্ছেন। তারা বলছেন, আপনি জনগণের সামনে প্রকৃত কোনো বিকল্প তুলে ধরছেন না। তাদের চোখে, এই পুরো প্রক্রিয়া ‘ঐক্যমতের’ ভাষায় মোড়ানো এক ধরণের কর্তৃত্ববাদ।

অধ্যাপক ইউনূস: এই প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে আওয়ামী লীগকে এখন আর রাজনৈতিক দল হিসেবে গণ্য করা যায় কি না— সেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে। যদি কোনো দল রাস্তায় তরুণদের গুলি করে মারে, মানুষকে গুম করে, রাষ্ট্রীয় অর্থ চুরি করে— তাহলে সেটিকে কি রাজনৈতিক দল বলা যায়? আমি কোনো ব্যক্তিগত রায় দিচ্ছি না, এটি একটি জাতীয় বিতর্ক।

গত ৫ আগস্ট যখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তখনই এই প্রশ্ন তীব্র হয়ে ওঠে। সেদিন পুরো বাংলাদেশে মানুষ রাস্তায় নেমে উৎসব করেছিল—তাঁদের মনে হয়েছিল, তারা মুক্ত। আমরা ভেবেছিলাম, ওই দিনই একটি অধ্যায়ের শেষ। সেই সাথে একটি অন্ধকার যুগও শেষ।

কিন্তু যারা পালিয়ে গেছেন, তারা থামেননি। বিদেশ থেকে তারা সহিংসতা উসকে দিচ্ছেন, বিশৃঙ্খলা ছড়াচ্ছেন। এ প্রক্রিয়া এখনো চলছে। এই পুরো সময়জুড়ে দলটির কোনো সদস্য একটিবারও অনুশোচনা প্রকাশ করেননি; কেউ বলেননি, ‘আমার কষ্ট লাগছে’, কিংবা “আমরা ভুল করেছি।” তাই আমাদের জন্য অধ্যায়টি শেষ হলেও, তাদের জন্য শেষ হয়নি।

এখনো তারা মাঠে-ময়দানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, সেই তরুণদের ওপর হামলা করছে যারা এই গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। এ কারণেই, জননিরাপত্তার স্বার্থে, রাষ্ট্র আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে।

আমি স্পষ্ট করে বলছি, আমরা দলটিকে নিষিদ্ধ করিনি। কোনো স্থায়ী সিদ্ধান্ত নেইনি। আমরা কেবল বিচারপ্রক্রিয়ার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছি।

ব্রনউইন ম্যাডক্স: বিচারপ্রক্রিয়া মানে— এই দলটির নেতাকর্মীদের বিচার?

প্রফেসর ইউনূস: যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে—তাদের সবার।

ব্রনউইন ম্যাডক্স: শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতের আশ্রয়ে, একটি নিরাপদ স্থানে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। প্রশ্ন হলো—এই বিচারপর্ব কি নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারত না? অন্তর্বর্তী সরকার কেন এখনই এটি সম্পন্ন করতে চাইছে?

অধ্যাপক ইউনূস: এই সিদ্ধান্ত আমি একা নিইনি। যখন আমরা দায়িত্ব নিই, তখন গণআন্দোলনের নেতারা আমাদের তিনটি কাজের দায়িত্ব দেন—আমরা সেটি গ্রহণ করি। এটা সেই দায়িত্বেরই একটি অংশ। আমরা কেবল আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছি—আর কিছু না।

ব্রনউইন ম্যাডক্স: এই সময়কাল নিয়ে আরেকটি প্রশ্ন। আমি সংবাদমাধ্যমে দেখেছি—এই সময়টিতে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস পেয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আপনার জবাব কী?

অধ্যাপক ইউনূস: এই অভিযোগ মিথ্যা। সংবাদমাধ্যম আগে কখনো এত স্বাধীন ছিল না। তাঁরা প্রতিদিন স্বাধীনভাবে সব কথা বলছে— তাঁদের কেউ থামাচ্ছে না।

ব্রনউইন ম্যাডক্স: এখন আমি আসতে চাই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে—অর্থনীতি। যে কোনো সরকারের জন্যই অর্থনীতি পরিচালনা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। জটিল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আপনি এই দায়িত্ব নিয়েছেন। তার মধ্যে এসেছে শুল্কযুদ্ধ, এই পরিবর্তন বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব ফেলেছে?

অধ্যাপক ইউনূস: আমাদের জন্য এটি সত্যিই কঠিন এক সময়। যখন বিশ্ব বাণিজ্য, শুল্ক ও সরবরাহ ব্যবস্থার সংকটে জর্জরিত, তখন আমরা একেবারে অন্যরকম সংকটে পড়েছি।

আমরা বলতে গেলে শূন্য থেকে নয়, ঋণাত্মক জায়গা থেকে শুরু করেছি। শূন্য হলে অন্তত কিছু থাকে—কিন্তু আমরা এমন একটি অবস্থায় ছিলাম, যেখানে কিছুই ছিল না।

এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে পূর্ববর্তী সরকারের তথাকথিত ‘মেগা প্রকল্প’ থেকে। প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগই জনগণের উপকারের জন্য নয়, ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে তৈরি। এখন এসব প্রকল্পের অর্থায়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে—দেনা পরিশোধের সময় হয়েছে। কিন্তু সরকারি কোষাগারে অর্থ নেই।

আমরা একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছি, যেখানে বলা হয়েছে—প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে, যা ব্যাংক ও ব্যাংকের বাইরের বিভিন্ন উৎস থেকে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই অর্থ পাচারের ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। রাজনৈতিক চাপ ও ভয়ভীতির মাধ্যমে ব্যাংকের পরিচালকরা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, আর তাদের জায়গায় বসানো হয়েছে অনুগতদের। অনেকে কোনো জামানত ছাড়াই ঋণ পেয়েছেন—এমন এক বোঝাপড়ায় যে, এই ঋণ ফেরত দিতে হবে না।

এখন সেই ঋণদাতারা, ঠিকাদাররা দাবি তুলেছেন— তাদের অর্থ ফেরত দিতে হবে। না দিলে তারা আন্তর্জাতিক আদালতে যাবে— এটি সত্যিই এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি।

তবুও, এই সংকটের মধ্যেও একটি আশার আলো আছে—প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য, এবং আরও অনেক দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা টাকা পাঠিয়ে যাচ্ছেন। এই রেমিট্যান্স আমাদের দেশের অর্থনীতিকে এখনো টিকিয়ে রেখেছে। তাদের কারণেই আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্ট কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে।

ব্রনউইন ম্যাডক্স: আপনি ঠিকই বললেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের জন্য জীবনরেখা হয়ে উঠেছে। কিন্তু আরেকটি বড় আন্তর্জাতিক অংশীদার—আইএমএফ—এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত। তারা স্পষ্টভাবে বলেছে—এই অন্তর্বর্তী সরকারকেই অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করতে হবে।

বিশেষ করে তারা কর ব্যবস্থার সংস্কার চায়—কর-ভিত্তি প্রসার, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি ও কর-ফাঁকি রোধ। আপনার কি মনে হয়, এই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এসব করা সম্ভব?

অধ্যাপক ইউনূস: প্রথমেই আমি যে বিষয়টি বলব, তা হলো—বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সরকার আমাদের যে সমর্থন দিয়েছে, তা অভাবনীয়। অনেক দেশ থেকেই বলা হয়েছে, ‘আপনারা যা প্রয়োজন, জানিয়ে দিন—আমরা সাহায্য করতে প্রস্তুত।’

এটি আমাদের জন্য এক বিশাল নৈতিক অনুপ্রেরণা। এটি আমাদের আশ্বস্ত করেছে যে আমরা একা নই। যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন— প্রতিটি বড় দেশের পক্ষ থেকেই আমাদের প্রতি সহানুভূতি জানানো হয়েছে। এই সংহতি আমাদের মনোবল বাড়িয়েছে।

আপনি আইএমএফের কথা বললেন— হ্যাঁ, তারা আমাদের পাশে রয়েছে, ঠিক যেমন বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিও রয়েছে।

ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: সবাই মনে হয়, এমন প্রশংসামূলক শব্দ ব্যবহার করছে না, তাই আমি একটু…

অধ্যাপক ইউনূস: না, আমি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথাই বলছি। আইএমএফ তখন যুক্ত হয়, যখন তারা অর্থ ছাড়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। তারা জোর দিয়ে বলল, আমাদের অবশ্যই মুদ্রার বিনিময় হার বাজারে ছেড়ে দিতে হবে। আমরা এতে শঙ্কিত ছিলাম, কারণ এত দিন ধরে সরকার নিয়ন্ত্রিত বিনিময় হার বজায় রেখেছিলাম, যাতে বৈদেশিক মুদ্রা দ্রুত বেরিয়ে না যায়। এটিকে বাজারে ছেড়ে দেওয়া একটি বড় সিদ্ধান্ত ছিল।

আমরা অনেক আলোচনা করেছি। কিন্তু আইএমএফ বলল, ‘আমরা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছি, আপনি এই ঝুঁকি নিতে পারেন।’ তখন আমরা একটি শর্তে সম্মত হই—যদি পরিস্থিতি খারাপ হয়, আমরা আবার আগের ব্যবস্থায় ফিরতে পারব। আইএমএফ এতে সম্মত হয় এবং আমরা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করি।

এরপর দেখা গেল, পরিস্থিতি খুব বেশি খারাপ হয়নি। বিনিময় হার কিছুটা ওঠানামা করেছে, তবে সেটি স্বাভাবিক পর্যায়েই থেকেছে। এখন আমরা এটিকে একধরনের সাফল্য হিসেবে দেখছি। এটি প্রমাণ করে যে, আমাদের অর্থনীতি একেবারে ধ্বংসপ্রাপ্ত নয়।

তাই আমি বলব, আইএমএফ আমাদের বিপদে ফেলতে নয়, বরং সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়েছে। তারা বলেছে, ‘আপনারা পারবেন’,— আমরাও তা প্রমাণ করেছি। এজন্য আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।

ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: আচ্ছা, এখন আমি জানতে চাই ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে। শেখ হাসিনার আমলে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, দিল্লির সঙ্গে আপনার সরকারের সম্পর্ক কিছুটা শীতল। আর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক যেন একটু উষ্ণতর। আপনার মূল্যায়ন কী?

অধ্যাপক ইউনূস: আমরা সবার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। আমি আগেই বলেছি, পৃথিবীর সব দেশই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, আমরা এজন্য কৃতজ্ঞ। আমরা যেটা করছি, তা হলো—যেসব সহযোগিতা অতীতে পাওয়া যায়নি, এখন আমরা তা চাচ্ছি।

সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি আমরা মোকাবিলা করছি, তা হলো দুর্নীতি। বাংলাদেশ একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনের অনেক স্তর এতে জড়িত। এখন প্রশ্ন হলো—আমরা কীভাবে এই ব্যবস্থা পরিষ্কার করব? কী ধরনের সংস্কার আনতে হবে যাতে সরকার দুর্নীতিমুক্ত হয়?

গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠকে এ বিষয়ে আমি বিশ্বের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে আলোচনা করেছি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেয়েনের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছিল। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমাদের মতো দেশে এই দুর্নীতির দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী হতে পারে?’ তিনি হেসে বললেন, ‘আপনারা বিশ্বাস করবেন না, ইউরোপে এমন অনেক দেশ ছিল যেখানে দুর্নীতি এর চেয়েও খারাপ ছিল।’

তাঁরা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের লক্ষ্যে নিজেদেরকে পরিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছিল। এজন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল—সিস্টেম গড়ে তোলা হয়েছিল। আমরা সেখান থেকেই শিক্ষা নিচ্ছি—দুর্নীতি দমন করতে কীভাবে একটি কার্যকর ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলা যায়।

ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: তবে ইউরোপের দেশগুলোর ক্ষেত্রে চাপটা এসেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের ইচ্ছা থেকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন কোনো চাপ আছে কি—রাজনীতি বা সমাজের পক্ষ থেকে?

অধ্যাপক ইউনূস: এই মুহূর্তটি আমাদের জন্য ঐতিহাসিক। আমরা যদি এখন এটি না করতে পারি, তাহলে আর কোনোদিন পারব না। আমরা বিশ্বাস করি—এই মুহূর্তটি আমাদের সামনে ইতিহাসের একটি জানালা খুলে দিয়েছে। অন্য কোনো সরকার এমন সুযোগ পায়নি, কারণ তাদের ভোটের রাজনীতি আছে, পছন্দ-অপছন্দ আছে। আমাদের তেমন কিছু নেই। আমরা কারও ভোটে নির্বাচিত হইনি, কাউকে তুষ্ট করার দরকার নেই। এই নিরপেক্ষতা থেকেই আমাদের নৈতিক শক্তি আসে।

যুক্তরাজ্যের থিংক ট্যাংক চ্যাথ্যাম হাউসে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

যুক্তরাজ্যের থিংক ট্যাংক চ্যাথ্যাম হাউসে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: এই অল্প সময়—নয় বা দশ মাসে—আপনারা কীভাবে এটি করবেন? আমি জানি, দুর্নীতি আছে নাইজেরিয়ায়, দুর্নীতি প্রায় সব দেশেই সমস্যা। আপনি কী করছেন—একটু বলুন।

অধ্যাপক ইউনূস: আমি একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন, কেউ পাসপোর্ট বানাতে গেল। তখন কেউ একজন বলে, ‘সরকারি প্রক্রিয়ায় গেলে কয়েক বছর লেগে যাবে—হয়তো পাবেনই না। আমাকে কিছু টাকা দিন, বাসায় পৌঁছে দেব।’ এই লোকটি আসলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ‘মানুষ’।

মানে, অফিসিয়াল ব্যবস্থা আসলে নিয়ন্ত্রিত হয় দালালদের মাধ্যমে। কর্মকর্তারা এই টাকার ভাগ পান। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন থেকে পাসপোর্ট অনলাইনে দেওয়া হবে। মানুষ খুশি—ভাবল, এবার বুঝি সত্যি সেবা মিলবে। কিন্তু দেখা গেল, অনলাইন ফর্ম খোলে না, সার্ভার ডাউন, কেউ ইচ্ছা করে জটিলতা তৈরি করে রেখেছে। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত…

ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: হ্যা… অনেক দেশ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দালাল নির্ভরতা কমাতে সফল হয়েছে…

অধ্যাপক ইউনূস: আমরাও সে পথেই এগোচ্ছি। আমরা ‘সরকারি’ শব্দটি ব্যবহার না করে ‘বাংলাদেশ সেবা কেন্দ্র’ নামে নতুন একটি উদ্যোগ চালু করেছি। এখানে প্রশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা বসে থাকেন, কম্পিউটারে নানা ধরনের সরকারি সেবা দিয়ে থাকেন। গত কয়েক মাসে আমরা সব মন্ত্রণালয়কে প্রস্তুত করেছি যাতে কর পরিশোধ, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট নবায়ন, এমনকি জটিল ভূমি করের মতো বিষয়গুলো অনলাইনে করা যায়।

এই সেবা কেন্দ্রগুলো আমরা গত মাসে শুরু করেছি। কেউ কেন্দ্রে এলে স্পষ্টভাবে নির্ধারিত মূল্যের তালিকা দেখতে পাবেন। যত দ্রুত সেবা চান, তার ভিত্তিতে হয়তো আপনার বাসায় ডেলিভারি হবে, অথবা মেসেজ পেয়ে আপনি এসে নিয়ে যাবেন। এই মুহূর্তে আমাদের তিনটি কেন্দ্র চালু রয়েছে এবং আগামী এক মাসে অনেকগুলো চালু করার পরিকল্পনা আছে।

আমরা প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি—তোমরা কতগুলো সেবা অনলাইনে দিতে পারবে? কেউ বলছে পাঁচটি, কেউ দশটি, কেউ আরও বেশি। আমরা বলি—যতগুলো পারো, দাও, আর আমরা স্টাফদের প্রশিক্ষণ দেব। কোথাও কোনো সমস্যা হলে আমরা একসঙ্গে বসে সমাধান করি। এটাই আমাদের কাজ।

এই অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য হলো—আমাদের মেয়াদ শেষে দেশের সব নাগরিক যেন ঘরে বসেই সরকারি সেবা পেতে পারেন। গ্রামের গৃহিণী বা দূরের কোনো নারীর জন্য শহরে আসার দরকার পড়বে না। কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন দিয়েই তিনি সেবা নিতে পারবেন।

আমরা এই যাত্রাপথ সম্পন্ন করতে চাই।

ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: এই ব্যাখ্যার জন্য ধন্যবাদ—বলা যায়, এটি সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। এবার আমি আরও কঠিন একটি বিষয়ে আসতে চাই—রোহিঙ্গা সংকট। লাখ লাখ রোহিঙ্গা এখন শিবিরে বসবাস করছে। এখন কী পরিকল্পনা? কী হবে ভবিষ্যতে?

অধ্যাপক ইউনূস: এই প্রশ্নটাই আমি প্রথমে তুলেছিলাম দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই। রোহিঙ্গা নিয়ে আলোচনা বলতে গেলে কে খাবার দিচ্ছে, কারা শিশুদের পড়ালেখার খরচ দিচ্ছে—এই পর্যন্তই সীমিত। কিন্তু আমি বলেছি—তাদের ভবিষ্যৎ কী? কবে তারা ফিরবে? এই প্রশ্নটাই কেউ করছে না।

আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থা সহায়তা দিচ্ছে বটে, কিন্তু প্রত্যাবাসনের জন্য কোনো রোডম্যাপ নেই।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আমি সংশ্লিষ্ট দাতাদেশগুলোর সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করেছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম—আপনাদের কি কোনো রোডম্যাপ আছে? তারা বলল, না, এখনো কোনো পরিকল্পনা হয়নি। তখন আমি বলি—প্ল্যান করেন, সেটা ১০ বছর লাগুক, ২০ বছর লাগুক, একটা তারিখ অন্তত থাকুক। প্রতি বছর পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই।

আমরা এখন চেষ্টা করছি যেন নিরাপদে প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়। তার মাঝেই হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্র ইউএসএইডের সব অর্থ সহায়তা বন্ধ করে দিল। যেমন, খাদ্য বাবদ মাথাপিছু ১২ ডলার দেওয়া হতো—সেটা বন্ধ। কেউ বলল ৬ ডলার করা হোক, কেউ বলল ৩ ডলার— কিন্তু ৩ ডলারে মাসে কী খাওয়ানো যায় কাউকে? আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বারবার বলেছি, ‘আপনারা বলেছিলেন রাখুন, আমরা রেখেছি। কিন্তু তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব আপনাদের। একে আমাদের একক দায়িত্ব ভাববেন না।’

যুক্তরাজ্য এখনো আমাদের অন্যতম প্রধান সহায়ক, বিশেষ করে এই সংকটকালে।

আমরা সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনের সঙ্গে মিলিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি বৈশ্বিক সম্মেলন করার জন্য চাপ দিচ্ছি।

যুক্তরাজ্যের থিংক ট্যাংক চ্যাথ্যাম হাউসে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

যুক্তরাজ্যের থিংক ট্যাংক চ্যাথ্যাম হাউসে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

এদিকে মিয়ানমারে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছে। রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি এখন নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে—এটাই মূল রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা। ফলে সেখান থেকে প্রায় ২ লাখ নতুন রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে, ১২ লাখের বেশি হয়ে গেছে শরণার্থীর সংখ্যা।

সবচেয়ে বড় বিপদের বিষয় যেটা আমি তুলে ধরছি তা হলো—এই নতুন প্রজন্ম। যারা এসেছিল, তাদের বয়স তখন পাঁচ কিংবা এর কম ছিল—এখন সাত বছর পর তারা বারো বছর বয়সে পৌঁছেছে। প্রতিবছর শিবিরে প্রায় ৩৫ হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে। এই প্রজন্ম বেড়ে উঠছে কোনো পরিচয় ছাড়াই, আশাহীন অবস্থায়। তারা যেন একপ্রকার কারাগারে বাস করছে, অথচ তাদের হাতে মোবাইল, কম্পিউটার আছে—বিশ্ব দেখছে তারা।

এই অবস্থায় এমন এক প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে যারা হতাশ, ক্ষুব্ধ—এবং তাদের ভবিষ্যৎ নেই।

এই ক্ষোভ কোন পথে যাবে, সেটা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটা নিশ্চিত, যদি কিছু করা না হয়, তাহলে একদিন এর পরিণতি ভয়ংকর হবে।

আমি সবাইকে বলছি—আমাদের এই চূড়ান্ত বিস্ফোরণ থেকে বাঁচাতে সাহায্য করুন। এই শিশুরা প্রতিভাবান, সৃষ্টিশীল, কিন্তু তারা বন্দি অবস্থায় আছে। তাদের বাবা-মার কথা শুনে বড় হচ্ছে, কিন্তু নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে বের করতেই হবে।

ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: তাহলে আপনার পরিকল্পনা এখনো প্রত্যাবাসনের দিকেই, তাই তো? তাদের বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে রাখার কোনো পরিকল্পনা নেই?

অধ্যাপক ইউনূস: না, সেটা একেবারেই অসম্ভব। শিবির-সংলগ্ন এলাকার মানুষ খুব বিরূপ, এবং তাদের ক্ষোভটা কিছুটা যৌক্তিক। তারা দেখে, রোহিঙ্গারা সব কিছু বিনামূল্যে পাচ্ছে, আর তারা নিজেরাই টিকে থাকার লড়াই করছে। তারা বলে, ‘তোমরা আমাদের চাকরি নিচ্ছ, খাবার নিচ্ছ, আমাদের জীবন কেড়ে নিচ্ছ। তোমরা নিজের দেশে যাও, আমাদের জীবনে হস্তক্ষেপ করো না।’

রোহিঙ্গাদের অনেকের কাছে শিবিরজীবন হয়তো মজার, অলস সময় কাটানোর মতো— কিন্তু স্থানীয় শিশুদের কঠিন বাস্তবতা আছে, যাদের কোনো সুযোগ নেই। এর ফলে একধরনের ক্ষোভ ও উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। সরকার এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে—রোহিঙ্গারা ফিরবে। তারা সেটা বুঝে। বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলই বা সরকারই স্থায়ী বসবাসের পক্ষে নয়।

ব্রনওয়েন ম্যাডক্স: আপনার বক্তব্য পরিষ্কার। এখন অনলাইনে অনেকেই প্রশ্ন পাঠাচ্ছেন—আমি প্রশ্ন পর্বে যাচ্ছি।



আরও দেখান
Back to top button