শিরোনাম

দুর্নীতি ও পলাতক পরিচালকদের দাপট ও গ্রাহক ক্ষতি

দুর্নীতি ও পলাতক পরিচালকদের দাপট ও গ্রাহক ক্ষতি

অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বিমা খাতের অবস্থা এমনিতেই বেহাল। সেই সংকটের মাত্রা আরও গভীর হয়েছে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে বিমা খাতের প্রায় অর্ধেক কোম্পানির শতাধিক পরিচালক পলাতক কিংবা জেলে। তাঁদের অনুপস্থিতিতে অনিয়ম-নৈরাজ্যের জেরে প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

বিমা খাতের পলাতক ও কারাবন্দী কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন ২৭ জন সাবেক মন্ত্রী, মেয়র ও সংসদ সদস্য (এমপি)। সশরীর উপস্থিত হতে না পারায় তাঁদের অনেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ভার্চুয়ালভাবে (অনলাইনে) পর্ষদ সভায় অংশগ্রহণ করছেন। নিয়মিত নিচ্ছেন বেতন-ভাতা ও বিভিন্ন খরচের অর্থ।

বিমা বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চেয়ারম্যান ও পরিচালকেরা মাসের পর মাস অনুপস্থিত থাকায় কোম্পানি ও গ্রাহকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোম্পানির কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। অনিয়ম ও দলাদলি জেঁকে বসেছে। বর্তমান পরিচালক, নির্বাহীসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিভিন্ন খাতে খরচের নামে অর্থ লোপাটের ছক কষছেন। এতে গ্রাহকদের বিমার অর্থের দাবি পূরণ না হওয়ার শঙ্কা বাড়ছে। শেয়ারহোল্ডাররা বঞ্চিত হচ্ছেন মুনাফা থেকে।

বিমা খাতের পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট কোম্পানির নিরীক্ষকেরা এসব অসংগতি তুলে ধরছেন না। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও দায়িত্বশীল আচরণ করছে না। যথাযথ নজরদারি না থাকায় কোম্পানিগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা লাগামছাড়া হয়ে উঠছেন।

সরকারি দুটিসহ দেশে ৮২টি বিমা কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ৬০টি বিমা কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এর একটি বড় অংশ অনুমোদন পেয়েছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের আগে ৭০টি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামী লীগের নেতাদের হাতে। এসব কোম্পানির পরিচালক ও চেয়ারম্যান পদে ছিলেন তাঁরা। পটপরিবর্তনের পর এর মধ্যে ৬০টি কোম্পানির পরিচালক বা চেয়ারম্যানরা পদ ছেড়ে দিয়ে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা ব্যবসায়িক অংশীদারদের বসিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ঠিক রেখেছেন। তবে ১০ কোম্পানির চেয়ারম্যানসহ ৩৬টি কোম্পানির ১১২ জন পরিচালক এখনো পদ ছাড়েননি। তাঁরা দেশ-বিদেশে পলাতক বা কারাগারে থাকলেও পদে বহাল রয়েছেন।

পলাতক চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সূত্রে জানা গেছে, এক বছরের বেশি সময় ধরে পলাতক রয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ইসলামী ইনস্যুরেন্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সাঈদ খোকন। একইভাবে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচা সোনার বাংলা ইনস্যুরেন্সের চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন। আরও পলাতক রয়েছেন সাবেক এমপি ও রূপালী লাইফের মাহফুজুর রহমান, আলফা ইসলামী লাইফের আলমগীর শামসুল আলামিন, এনআরবি ইসলামী লাইফের কিবরিয়া গোলাম মোহাম্মদ, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক এবং সন্ধানী লাইফ ইনস্যুরেন্স ও পূরবী জেনারেল ইনস্যুরেন্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান মজিবুল ইসলাম পান্না। সাবেক এমপি ও ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্সের চেয়ারম্যান মোরশেদ আলম কারাগারে।

কর্মকর্তারা বলছেন, কোম্পানিগুলোতে চেয়ারম্যানরা সশরীর উপস্থিত না হলেও তাঁদের গাড়ির খরচ, জ্বালানি খরচ এমনকি চালকের বেতন দেওয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠান থেকে। নেওয়া হচ্ছে মোবাইল ফোনের বিলও। একই অবস্থা পরিচালকদের ক্ষেত্রেও।

সম্প্রতি রাজধানীর পুরানা পল্টনের ডিআর টাওয়ারে সাঈদ খোকনের ইসলামী ইনস্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, অভ্যর্থনা কক্ষে একের পর এক আসছেন বিমার দাবি না মেটা গ্রাহক। তাঁদের কাউকে বলা হচ্ছে, কাগজপত্র দিয়ে যেতে, কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। কাউকে বলা হচ্ছে, এখন কোম্পানির অবস্থা ভালো নেই, টাকা পেতে দেরি হবে। এসব কথা শুনে গ্রাহকেরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এ বিষয়ে জানতে ইসলামী ইনস্যুরেন্সের সিইওর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে বলা হয়, ‘স্যার কারও সঙ্গে কথা বলেন না।’ জনসংযোগ বিভাগের প্রধান বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে চেয়ারম্যান ও পরিচালক স্যার নিয়মিত আসছেন না। তাই সব কাজ করা যাচ্ছে না।’

পরে ফোনে কথা হলে সিইও আব্দুল খালেক মিয়া বলেন, ‘চেয়ারম্যান পলাতক। তিনি জুমে (অনলাইনে) পর্ষদের সভা করেন। কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করছেন ভাইস চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ। আর কিছু বলতে পারব না।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, কোম্পানিতে এখন দুটি গ্রুপ হয়েছে। পৃথক গ্রুপ দুটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভাইস চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ ও সিইও আব্দুল খালেক মিয়া। দুর্নীতির অভিযোগে সম্প্রতি সিইওকে চাকরিচ্যুত করেছেন ভাইস চেয়ারম্যান। তবে নিয়মবহির্ভূতভাবে হওয়ায় এই চাকরিচ্যুতির আবেদন নামঞ্জুর করেছে বিমার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।

রূপালী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের সাবেক এমপি মাহফুজুর রহমান। তিনি পলাতক থাকায় সিইও গোলাম কিবরিয়া কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে মিলে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া কোম্পানিটিতে একাধিক গ্রুপ তৈরি হয়েছে।

এ বিষয়ে রূপালী লাইফ ইনস্যুরেন্সের সচিব আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘চেয়ারম্যান নিয়মিত অফিস করেন না, প্রয়োজনে আসেন, আবার চলে যান।’ তবে ডিএমডি জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘চেয়ারম্যান পলাতক। তিনি পর্ষদ সভা করেন জুমে। মিটিংয়ের নামে টাকা নিচ্ছেন। তিনি অফিসে না আসায় মিটিংয়ের নামে গ্রাহকদের অর্থ লোপাট চলছে।’

ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্সের সিইও কাজিম উদ্দিন পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, দৈনন্দিন কাজ চলছে। এক বছর ধরে চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকায় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে না।

পলাতক পরিচালকেরা পলাতক হিসেবে বিবেচিত পরিচালকদের মধ্যে রয়েছেন ইসলামী ইনস্যুরেন্সের চেয়ারম্যান সাঈদ খোকনের স্ত্রী ফারহানা সাঈদ, মা শাহানা হানিফ, মেয়ে রাইফা নানজিবা সাঈদ, আয়েশা নিভরাশ সাঈদ এবং ফাতিমা নওশিন মাইয়া সাঈদ অরোরা ও শ্যালিকা রিজওয়ানা হোসেন।

সন্ধানী লাইফ ইনস্যুরেন্স ও পূরবী জেনারেল ইনস্যুরেন্স এই দুই বিমা কোম্পানি আওয়ামী লীগ নেতা হাজী মকবুল হোসেনের। তাঁর মৃত্যুর পর সন্ধানী লাইফ ইনস্যুরেন্সের উপদেষ্টা হন সাবেক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। পরিচালক হিসেবে রয়েছেন তাঁর মা গোলাম ফাতেমা তাহেরা খানম। এ ছাড়া পূরবী জেনারেলের উদ্যোক্তা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম চৌধুরী। তাঁরা সবাই পলাতক।

পলাতক রয়েছেন আলফা লাইফের পরিচালক ইন্তেখাবুল হামিদ অপুসহ আরও তিনজন। অপু সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ভাই।

সাবেক দুই মন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীর ও ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের কোম্পানি যমুনা লাইফ ইনস্যুরেন্স। তাঁরা উভয়ে কারাগারে। কোম্পানির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন গাজী গ্রুপের সাবেক কর্মকর্তা বদরুল আলম খান। পলাতক পরিচালকদের মধ্যে রয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা, মেয়ে মেহেনাজ তাবাসসুম, ছেলের বউ ফারহানা ফেরদৌসি ইমতিয়াজ।

পলাতক রয়েছেন বেস্ট লাইফ ইনস্যুরেন্সের চেয়ারম্যান সাবেক এমপি আব্দুল হাফিজ মল্লিক ও পরিচালক ড. নাদিয়া বিনতে আমিন, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক।

পলাতক রয়েছেন সাবেক এমপি ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের এশিয়া ইনস্যুরেন্স পিএলসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোস্তফা হায়দার। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালের কোম্পানি এশিয়া প্যাসিফিক জেনারেল ইনস্যুরেন্স। তাঁর স্ত্রী কাশমেরী কামাল এর চেয়ারম্যান এবং মেয়ে নাফিসা কামাল পরিচালক ছিলেন। তাঁরা সবাই পলাতক।

সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের প্রতিষ্ঠান জনতা ইনস্যুরেন্স। এই কোম্পানির চেয়ারম্যান মন্ত্রীর মামা জাফরুল ইসলাম চৌধুরী, ভাইস প্রেসিডেন্ট তাঁর আত্মীয় ফারহানা জামান এবং তাঁর মেয়ে জেবা জামান পলাতক রয়েছেন। লক্ষ্মীপুরের সাবেক এমপি তাকাফুল ইসলামী লাইফের পরিচালক ড. আনোয়ার হোসেন খানও পলাতক।

ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের সিইও মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে চেয়ারম্যান দেশের বাইরে রয়েছেন। কিছুদিন ভার্চুয়াল মিটিং হয়েছে। কোম্পানির স্বার্থে সর্বশেষ সভায় নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হয়েছে।

পলাতক রয়েছেন সাবেক এমপি নিটল ইনস্যুরেন্সের চেয়ারম্যান সেলিমা আহমাদ। সেলিমার পদে বসেছেন তাঁর ভাই এ কে এম মনিরুল হক। পলাতক রয়েছেন বেঙ্গল ইসলামী লাইফের পরিচালক সাবেক এমপি জেসমিন আখতার।

সব মিলিয়ে ১৯টি জীবনবিমা এবং ১৭টি সাধারণ বিমাসহ ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের শতাধিক পরিচালক পলাতক রয়েছেন।

বিশেষজ্ঞ ও নিয়ন্ত্রক যা বলেন

বিমা বিশেষজ্ঞ ও চার্টার্ড লাইফ ইনস্যুরেন্সের সাবেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এস এম জিয়াউল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ রেগুলেটরি দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে কোম্পানিগুলো। এর ফলে গ্রাহকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর বিমা খাত রুগ্‌ণ হচ্ছে।’

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) পরামর্শক সাইফুন্নাহার সুমি বলেন, ‘জুমে পর্ষদ সভা করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, এটা করা যাবে না। এখন পর্যন্ত কোনো কোম্পানির বিষয়ে অভিযোগ আসেনি, তাই বিষয়টি খতিয়ে দেখা হয়নি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আমাদের কাজ বিমা কোম্পানির ওপর নজরদারি করা। কিন্তু লোকবলের অভাবে তা যথাযথভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার অনিয়ম পেলেও কোম্পানির পর্ষদ পুনর্গঠন করা কিংবা নতুন বোর্ড গঠনের ক্ষমতা আইডিআরএর নেই।


ক্রাইম জোন ২৪

আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button