শিরোনাম

৩০% প্রবৃদ্ধি, এলডব্লিউজি সনদ ও পরিবেশগত উন্নয়নে গুরুত্ব

৩০% প্রবৃদ্ধি, এলডব্লিউজি সনদ ও পরিবেশগত উন্নয়নে গুরুত্ব

অর্থনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা আর বাণিজ্যযুদ্ধের চাপের মাঝে দেশের চামড়াশিল্প আবারও ডানা মেলছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসের রপ্তানির পরিসংখ্যান সেই জাগরণের স্পষ্ট প্রমাণ। পরিবেশগত দুর্বলতার কারণে একসময় অবহেলায় ঢেকে থাকা খাতটি এখন আবার আলোয় ফিরছে। কারখানার উৎপাদন পরিবেশে উন্নয়ন এনে কিছু উদ্যোক্তা আন্তর্জাতিক লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ অর্জন করেছেন, যা কঠিন পথকে অনেকটা সহজ করেছে। তা ছাড়া স্থানীয় কাঁচা চামড়ার রপ্তানি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পাশাপাশি বিশ্ববাজার থেকে চামড়া আমদানির মাধ্যমে দেশে মানসম্মত পণ্য তৈরি এবং মূল্য সংযোজনের প্রবণতা বেড়েছে। এভাবে ধীরে ধীরে বিশ্ববাজারে শক্ত জায়গা করে নিচ্ছে বাংলাদেশের চামড়াশিল্প।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছর ২০২৫-২৬ সালের প্রথম মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৭৩ লাখ মার্কিন ডলার। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লম্ফন ঘটেছে চামড়াজাত পণ্যে; ৪১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। চামড়ার তৈরি জুতা রপ্তানি বেড়েছে ২৫ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং সরাসরি চামড়া রপ্তানি বেড়েছে ২১ দশমিক ৯০ শতাংশ।

এ বিষয়ে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. আব্দুর রাজ্জাক আজকের পত্রিকাকে বলেন, হঠাৎ চামড়া খাতে প্রবৃদ্ধির পেছনে মূলত তিনটি কারণ কাজ করছে। প্রথমত, সংখ্যার এই উল্লম্ফনের পেছনে অন্যতম কাজ করেছে বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধের ভূরাজনীতি। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হওয়ার পর চীনের ওপর পাল্টা শুল্ক বসানোয় মার্কিন আমদানিকারকেরা বিকল্প উৎস খুঁজতে শুরু করেছেন। চীন থেকে সরে আসা অর্ডারের একাংশ এখন বাংলাদেশে ঢুকছে। আর এখানেই সুযোগ তৈরি হচ্ছে দেশের চামড়া ও জুতাশিল্পের জন্য। দ্বিতীয়ত, ইউরোপ ও আমেরিকা মূল্যস্ফীতির ধাক্কা কাটিয়ে আমদানি বাড়িয়েছে এবং তৃতীয়ত, রপ্তানির বেস তুলনামূলক ছোট হওয়ায় সামান্য অগ্রগতিও শতাংশের হিসাবে বড় হয়ে ধরা দিচ্ছে।

তবে ড. আব্দুর রাজ্জাক সতর্ক করে বলেন, এই ধারা টেকসই করতে হলে অবকাঠামো ও বন্দর সুবিধা বাড়াতে হবে, দ্রুত পণ্য খালাসের ব্যবস্থা করতে হবে এবং পরিবেশ সনদ অর্জনে মনোযোগ দিতে হবে।

রপ্তানিকারকেরা বলছেন, বাংলাদেশের তৈরি চামড়া ও চামড়াবিহীন জুতার সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। আগামীতেও এ বাজারে সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা অপেক্ষা করছে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদের ভাষায়, ‘এই সম্ভাবনা আরও জোরদার হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের শুল্ক প্রতিযোগী দেশ ভারত, ভিয়েতনাম কিংবা ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে তুলনামুলক বেশি না হওয়ায়। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখানে আগ্রহী হবে; বিশেষত চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে আসতে পারে।’

রপ্তানি আয় নিয়ে হিসাব কষলে চিত্র আরও স্পষ্ট হয়। শুধু জুলাই মাসেই চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৩ কোটি ৮৩ লাখ ডলারের, যা গত বছর ছিল ২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। চামড়া রপ্তানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯২ লাখ ডলারে, আগের বছর যা ছিল ৭৫ লাখ ডলার। আর জুতার বাজারে লাফিয়ে বেড়ে রপ্তানি পৌঁছেছে ৭ কোটি ৯৮ লাখ ডলারে, যা আগের বছর ছিল ৬ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। গত অর্থবছরেই ৬৭ কোটি ডলারের চামড়ার জুতা রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একাই নিয়েছে ৪৩ শতাংশ; প্রায় ২৯ কোটি ডলার। এরপরই আছে নেদারল্যান্ডস, কানাডা ও জার্মানি।

কিন্তু খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই উল্লম্ফন এখনো সামর্থ্যের অর্ধেকও নয়। লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি নাসির খানের মতে, ‘আমাদের লেদার সেক্টর থেকে বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার আয় সম্ভব। অথচ বর্তমান অবস্থায় দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি করা যাবে না। এর জন্য সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত জরুরি।’

সমস্যার তালিকাও ছোট নয়। এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় অনেক ক্রেতা বাংলাদেশকে এড়িয়ে যাচ্ছে। সাভারের কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) কার্যকারিতা নিয়ে দীর্ঘদিনের অভিযোগও রপ্তানিতে বড় বাধা। পরিবেশবান্ধব উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে না উঠলে বৈশ্বিক ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেবেন—এই আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।


ক্রাইম জোন ২৪

আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button