চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত নাগরিক
চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত নাগরিক


বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে উন্নতির পথে এগিয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে শুরু করে উপজেলা কমপ্লেক্স, মেডিকেল কলেজ এবং বিশেষায়িত হাসপাতাল পর্যন্ত একের পর এক অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। এসব উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। কারণ আজ এই খাত জর্জরিত দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বচ্ছতার অভাবে। চিকিৎসা নিতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রায়ই অবহেলা, বাড়তি খরচ, ঘুষ কিংবা প্রতারণার শিকার হতে হয়। সরকারি হাসপাতালের প্রতি আস্থা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে এবং দরিদ্র মানুষ কার্যত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সরকারি হাসপাতালে সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে প্রায়ই দুর্নীতি হয়। অতিরিক্ত বিল দেখিয়ে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি আনা হয়, যেগুলো ব্যবহারের আগেই অকেজো হয়ে পড়ে। কোটি টাকার মেশিন ধুলোয় পড়ে থাকার দৃশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। একইভাবে ওষুধ সরবরাহের ক্ষেত্রেও অনিয়ম প্রকট। রোগীদের জন্য বরাদ্দ বিনামূল্যের ওষুধ প্রায়শই কালোবাজারে বিক্রি হয়, ফলে গরিব রোগীদের চড়া দামে বাইরে থেকে কিনতে হয়। শুধু তাই নয়, হাসপাতাল নির্মাণ ও সংস্কারের টেন্ডার প্রক্রিয়াতেও অসৎ চক্র ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিম্নমানের কাজ করিয়ে সরকারি অর্থ লুটে নেয়।
চাকরি, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রেও অনিয়ম বিস্তৃত। যোগ্যতার পরিবর্তে ঘুষ, রাজনৈতিক পরিচয় ও সুপারিশ প্রাধান্য পায়। এর ফলে অযোগ্য ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে সেবার মান আরও খারাপ করে তোলে। রোগীর স্বজনদের কাছ থেকেও নানা অজুহাতে টাকা আদায় করা হয়। অপারেশন, জরুরি সেবা বা ওয়ার্ডে ভর্তি—সবখানেই লুকানো খরচ চাপিয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালের ভেতরে সক্রিয় দালালচক্র রোগীদের ভুল বুঝিয়ে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যায়, যেখানে খরচ বহুগুণ বেশি।
এই দুর্নীতির মূল শেকড় হলো দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, জবাবদিহিতার অভাব এবং ক্ষমতার অপব্যবহার। ক্রয় কমিটিতে অসৎ কর্মকর্তাদের প্রভাব, অপ্রয়োজনীয় ও নিম্নমানের যন্ত্রপাতি কেনা, দক্ষ জনবল নিয়োগ না দেওয়া এবং অবৈধ ক্লিনিক বা মেডিকেল কলেজ পরিচালনা—সবই একই চক্রের অংশ। অনেক চিকিৎসক নিজের স্বার্থে রোগীদের বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠান, এমনকি কিছু কোম্পানির চাপে নকল বা নিম্নমানের ওষুধও প্রেসক্রাইব করেন। এতে জনগণের স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
এই দুর্নীতির ভয়াবহ প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে দরিদ্র মানুষের ওপর। যাদের সামর্থ্য নেই, তারা ভালো চিকিৎসা পাচ্ছে না। অনেকেই বিনা চিকিৎসায় বা ভুল চিকিৎসায় প্রাণ হারাচ্ছে। যারা সামর্থ্যবান, তারা বিদেশে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছে, ফলে দেশের বিপুল অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। সরকারি হাসপাতালের প্রতি আস্থা কমে যাওয়ায় মানুষ বাধ্য হয়ে ব্যয়বহুল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্যের মান ক্রমেই নিম্নমুখী হচ্ছে।
তবে এই অচলাবস্থা ভাঙা সম্ভব। প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কঠোর আইন প্রয়োগ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। হাসপাতালের বাজেট ও খরচ প্রকাশ্যে আনতে হবে, দুর্নীতি প্রমাণিত হলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল মনিটরিং ব্যবস্থার মাধ্যমে ওষুধ সরবরাহ ও সেবার মান ট্র্যাক করা যেতে পারে। দক্ষ জনবল নিয়োগ, যন্ত্রপাতির সঠিক ব্যবহার, দালালচক্র দমন এবং অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা জরুরি। পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে হবে যাতে মানুষ নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত আজ এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। দুর্নীতি কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, এটি মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। গরিব রোগী যখন বিনামূল্যের ওষুধ না পেয়ে কালোবাজারে কিনতে বাধ্য হয়, অথবা দালালের হাতে পড়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে সর্বস্ব হারায়, তখন রাষ্ট্রের ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু যদি কঠোর জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, তবে এই খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক সমানভাবে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার ভোগ করবে। সেখানেই নিহিত একটি সুস্থ, সুন্দর ও উন্নত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।
—
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
লেখক ও সমাজ গবেষক