কিছুটা কমতে পারে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা


এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, এ বিষয়ে একমত রাজনৈতিক দলগুলো। আবার প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়াই সাংবিধানিক বাছাই কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে। ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করতে সরাসরি রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, প্রেস কাউন্সিল এবং আইন কমিশনের নিয়োগের পক্ষে মত দিয়েছে দলগুলো। যদিও একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান হতে পারবেন না—এই প্রস্তাবে দলগুলো একমত হতে পারেনি।
রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে তৈরি করা জুলাই জাতীয় সনদে এখনো বিষয়গুলো এভাবেই আছে। সব মিলিয়ে এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা গেলে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কিছুটা কমানো যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও তা কতটা ঠিক হচ্ছে, তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিকী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকার বিষয়ে ঐকমত্য আশাব্যঞ্জক। কিন্তু আমি আশা করি, অন্য যেসব সংস্কারের মাধ্যমে আমরা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাতে চাই, ভবিষ্যতে নির্বাচিত সংসদ সেগুলো বিবেচনা করে বাস্তবায়ন করবে।’
যদিও রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে কমিশনের নেওয়া পদক্ষেপ সঠিক নয় বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও সংসদবিষয়ক গবেষক নিজাম উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের নামে যে উদ্যোগ নেওয়া হলো, তা কোনো সংসদীয় পদ্ধতিতে নেই। কারণ প্রধানমন্ত্রীকে জবাবদিহির জন্য নানা প্রক্রিয়া তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতিকে এত ক্ষমতা দেওয়া হলেও দায়বদ্ধ বা জবাবদিহির প্রক্রিয়া রাখা হয়নি। এখানে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হবে এবং ক্ষমতার দুটো পাওয়ার সেন্টার তৈরি হবে।’
বিদ্যমান সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ বাদে বাকি সব কাজ রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করতে বাধ্য। এর মাধ্যমে বিচারপতি, সাংবিধানিকসহ স্বতন্ত্র আইনে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। যাতে প্রধানমন্ত্রীকে অপার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বলে দেশের রাজনৈতিক মহলে আলোচিত। এমন অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাতে এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয়প্রধান একই ব্যক্তি না হওয়া, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগের বিধান সংবিধানে রাখাসহ বেশ কিছু প্রস্তাব দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে ব্যক্তিজীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী, নির্বাচন কমিশন নিয়োগের বিধান সংবিধানে রাখার পক্ষে দলগুলো। বাকি প্রস্তাবে বিএনপি ও তার সমমনারা নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ায় বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
দেশে বর্তমানে এক ব্যক্তি যতবার যা যত দিন ইচ্ছা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারেন। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা টানা চারবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় তাঁর মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব তৈরি হয়েছিল বলে দাবি করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। এমন অবস্থায় একজন দুইবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের প্রস্তাব করেছিল সংবিধান সংস্কার কমিশন। তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে একজন সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের বিষয়ে একমত হয়। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয়প্রধান একই ব্যক্তিকে করার বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত দিলেও আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি, এনডিএম, ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদ সদস্যদের হাত-পা বাঁধা বলে দীর্ঘদিন ধরে দেশে চর্চিত। ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে প্রস্তাব তোলা হয়, অর্থবিল এবং আস্থা ভোট ছাড়া সব বিষয়ে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন এমপিরা। যদিও বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো সংবিধান সংশোধন এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দলের বিপক্ষে এমপিদের ভোটের সুযোগ দিতে চায় না।
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারণের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে সংসদের ভারসাম্য আনার চেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধী দলের এবং ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধন উদ্যোগকে ভালো বলে মনে করেন তাঁরা।
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরে ভিত্তিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি। কমিশনের আলোচনা অনুযায়ী, দলগুলো মন্ত্রিসভার অনুমোদনের ভিত্তিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণার পক্ষে। মন্ত্রিসভার সে বৈঠকে বিরোধীদলীয় নেতা অথবা বিরোধীদলীয় উপনেতা উপস্থিত থাকবেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনার জন্য কারও সুপারিশ ছাড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য; তথ্য কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য; বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও সদস্য; আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য; বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান এবং সদস্যদের নিয়োগ দিতে পারবেন রাষ্ট্রপতি। তবে বিএনপি, এলডিপি, লেবার পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট এবং এনডিএম বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের নিয়োগ প্রধানমন্ত্রীর হাতে রাখতে চান।
প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের বিধান সরাসরি রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে করার সমালোচনা করেন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, এদের নিয়োগে বাছাই কমিটি ছাড়া সরাসরি রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে হলে যেকোনো প্রক্রিয়ায় খারাপ লোকের নিয়োগের আশঙ্কা তৈরি হবে। এতে রাষ্ট্রীয় কাজে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
দেশের বিদ্যমান আইনানুযায়ী সার্চ কমিটির প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেন। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে সিইসি ও চার কমিশনার নিয়োগ দিয়ে থাকেন।
সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় সংসদের স্পিকারের নেতৃত্বে বাছাই কমিটির মাধ্যমে সিইসি ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিধান সংবিধানে যুক্ত করার পক্ষে। এ কমিটিতে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দল), প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধি হিসেবে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি থাকবেন। যে কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে একজন সিইসিসহ নির্ধারিত পদের বিপরীতে একজন করে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করবেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের পাশাপাশি নিয়োগের বিধান সংবিধানে রাখার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া ন্যায়পাল, সরকারি কর্ম কমিশনকে (পিএসসি) তিনটি ভাগে তথা পিএসসি (সাধারণ), পিএসসি (শিক্ষা) এবং পিএসসি (স্বাস্থ্য) এবং মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) নিয়োগের সম্পর্কিত বিধান সংবিধান যুক্ত করার পাশাপাশি বাছাই কমিটির মাধ্যমে করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা সংকুচিত হওয়ার দাবি করে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপি, এনডিএম, ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট। বিএনপির সমর্থন ছাড়া এসব বিষয়গুলো সংবিধানে সংযুক্ত করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
ক্রাইম জোন ২৪