জীবন থাকতে কবর থেকে ছেলের লাশ তুলতে দেব না: হাফেজ আজিজুলের বাবা-মা


‘আমাদের ছেলে শহীদ আজিজুল ইসলাম ৩০ পারা কোরআনের হাফেজ। তার লাশ তুললে তিনটা কবর খুঁড়তে হবে। একটায় থাকব ছেলে। বাকি দুইটায় আমরা স্বামী-স্ত্রী। জীবন থাকতে কবর থেকে হাফেজ ছেলের লাশ তুলতে দেব না।’ জুলাই আন্দোলনে শহীদ আজিজুল ইসলামের বাবা আব্দুর রহিম ও মা রেজিয়া বেগম এমন কথা জানান।
তাঁদের বাড়ি লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়নের ঝালঙ্গী গ্রামে। জুলাই শহীদ ছেলের লাশ না তুলতে কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিত আবেদনও করেছেন তাঁরা।
শহীদ আজিজুলের পরিবার ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, আজিজুল ইসলাম বরিশালের চরমোনাই মাদ্রাসা থেকে কোরআনের হাফেজ হয়ে ফিরে আসে। পরে স্থানীয় আউলিয়ার হাট আলিম মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। গত দাখিল পরীক্ষায় তার অংশ নেওয়ার কথা ছিল। এরই মাঝে দেশে জুলাই আন্দোলন শুরু হলে বাড়িতে ফাঁকি দিয়ে আন্দোলনে যায় আজিজুল ইসলাম।
গত বছরের ৫ আগস্ট বিকেলে বিজয় মিছিল বের হলে সবার সঙ্গে কাউয়ামারী বাজারে বিজয় মিছিলে অংশ নেয় আজিজুল। সেখানে মোশারফ হোসেন প্রধান কলেজের মূল ফটকের ডিজিটাল সাইনবোর্ড খুলে ফেলেছিল আজিজুল ইসলাম। দুর্ভাগ্যবশত সেখানে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়।
পরদিন তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। জুলাই আন্দোলনের বিজয় মিছিলে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলেও আজিজুল ইসলাম শহীদ হিসেবে গেজেটভুক্ত হয়েছে। এরপর চলতি বছরের ৩০ জুন ঘটনার প্রায় ১০ মাস পরে পাটগ্রাম থানায় আজিজুল হত্যায় মামলা করেন পার্শ্ববর্তী উপজেলার সিংগিমারী এলাকার আব্দুস সালামের ছেলে মোশারফ হোসেন।
অপরিচিত ব্যক্তির করা হত্যা মামলার খবর শুনে আট দিন পরে তা প্রত্যাহার করতে স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শকসহ ঊর্ধ্বতন বিভিন্ন মহলে আবেদন করেন শহীদ আজিজুলের বাবা আব্দুর রহিম।
সেই মামলায় শহীদ আজিজুলের লাশ কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্তের অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শাহাজাহান আলী। এটা শুনে ক্ষিপ্ত হয় শহীদ পরিবারসহ পুরো এলাকাবাসী।
তাদের দাবি, কোরআনের হাফেজের লাশ এক বছর পরে কবর থেকে তুলতে দেওয়া হবে না। শহীদ আজিজুলের লাশ কবর থেকে না তুলতে আদালতসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত আবেদন করেন শহীদ আজিজুলের বাবা আব্দুর রহিম।
শহীদ আজিজুলের দাদি রুপজান বেওয়া বলেন, ‘আমার নাতির রক্তে দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীন দেশে নিরপরাধ মানুষকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে হয়রানি করলে শহীদের আত্মা কষ্ট পাবে। আমার নাতি বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেছে। আমাদের কারও প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। এখন নাতির লাশ তুললে আমি বাঁচব না।’
আব্দুর রহিম বলেন, ‘আমার ছেলে শহীদ আজিজুল ইসলাম কোরআনের একজন হাফেজ। সে জুলাই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল এবং বিজয় মিছিলে গিয়ে কলেজের সাইনবোর্ড ভাঙতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যায়। আমরা তাকে দাফন করেছি। রাষ্ট্র তাকে শহীদের মর্যাদা দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে। তার মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনামাত্র।
‘কারও প্রতি কোনো ক্ষোভ বা অভিযোগ ছিল না এবং নেই। মৃত্যুর ১০ মাস পরে বর্তমান ওসি মিজানুর রহমান আমাদের মামলা করার চাপ দিয়েছিল। আমরা মামলা করিনি। পরে মোশারফ নামে অপরিচিত একজন বাদী হয়ে মামলা করেছে।
‘শহীদের বাবা ও একজন সাক্ষী হিসেবে সে মামলা প্রত্যাহার করতে আবেদন করেছি। মিথ্যা মামলায় মানুষকে হয়রানি করলে আমার হাফেজ ছেলের কবরে আজাব হবে, আমরা তা চাই না।’
আজিজুলের মা রেজিয়া বেগম বলেন, ‘আমার কলিজা আজিজুল ৩০ পারা কোরআন মুখস্থ করেছে। তার লাশ কবর থেকে তুলতে দেব না। কেউ জোর করে তুললে তিনটা কবর খুঁড়তে হবে। একটা ছেলের, অপর দুইটাতে আমরা স্বামী-স্ত্রী থাকব। এক বছর পর কোরআনের হাফেজের লাশ দেখলে আমরা মরে যাব। আমরা মামলা চাই না। আমার ছেলের লাশকে পুঁজি করে কেউ কেউ মামলা-বাণিজ্য করবে। আমরা বেঁচে থাকতে তা হতে দেব না। ওসি বারবার ডেকেছিল মামলা করতে। আমরা বলেছি, ছেলে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেছে। আমরা মামলা করব না। অপরিচিতদের দিয়ে মামলা করেছে পুলিশ।’
এ মামলার বাদী মোশারফ হোসেন বলেন, ‘শহীদ আজিজুল আমার সহযোদ্ধা ছিল। তার পরিবার মামলা করতে সাহস করেনি এবং তাদের নির্দেশে আমি বাদী হয়ে মামলা করেছি। তবে মামলা-বাণিজ্যের প্রমাণ দিতে পারলে সব শাস্তি মেনে নেব। বাণিজ্যের অভিযোগটি ভিত্তিহীন।’
গত বছরের ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে গিয়ে পাটগ্রামের দুজনের মৃত্যু হয়েছে। একজন শহীদ আজিজুল ইসলাম (১৯), অপরজন শহীদ নুরুজ্জামান (৪৫)। তাদের বাড়িও পাশাপাশি এলাকায়। নুরুজ্জামান আউলিয়ারহাট এলাকায় বিজয় মিছিলে গিয়ে হোঁচট খেয়ে সড়কে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন। পরে পাটগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ৬ আগস্ট রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ৮ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নুরুজ্জামানের মৃত্যুর ঘটনায়ও ১০ মাস পরে চলতি বছরের ৩০ জুন পাটগ্রাম থানায় ৪১ জনের নামসহ অজ্ঞাতনামা ৫০-৬০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন নিহত ব্যক্তির পরিবারের অপরিচিত আলী হোসেন। যিনি মামলার ৮ দিনপর তা প্রত্যাহারের আবেদন করেন।
জুলাই আন্দোলনের ঘটনায় পাটগ্রাম থানায় চলতি বছরের ৩০ জুন করা দুই মামলায় (২১ ও ২২ নম্বর) বিএনপিরও পাঁচ থেকে সাতজন নেতাকে আসামি করা হয়েছে। মামলা দুটি প্রত্যাহার করতে বাদী ও দুই শহীদ পরিবার একই দিনে পৃথক পৃথক প্রত্যাহারেরও আবেদন করেছে। যা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল। মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে বিএনপি নেতারাও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। মামলা দুটিতে ব্যাপক বাণিজ্য হয়েছে বলেও দাবি বাদী ও নিহত ব্যক্তির পরিবারের।
নুরুজ্জামান হত্যা মামলায় ২৭ থেকে ৩১ নম্বর আসামির তালিকায় শ্রীরামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদল, কৃষক দল, স্বেচ্ছাসেবক দলের পদধারী নেতাদের নাম দেওয়া হয়েছে। রয়েছেন ইউনিয়ন ছাত্রদলের সম্পাদক, কৃষক দলের সহসভাপতি, স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যসচিব ও যুগ্ম আহ্বায়ক।
নুরুজ্জামান হত্যা মামলার ২৭ নম্বর আসামি শ্রীরামপুর ইউনিয়ন কৃষক দলের সহসভাপতি হিটলার বলেন, ‘জুলাই আন্দোলন করেছি, এখন সেই আন্দোলনের হত্যা মামলার আসামিও হলাম আমরা পাঁচজন। আমার ছেলে, শ্যালক, চাচাত ভাই, বন্ধুর ছেলে সবাই বিএনপির সহযোগী সংগঠনের নেতা। দলীয় কোন্দল থেকে আমাদের আসামি করা হয়েছে। যা দলীয় উচ্চপর্যায়ে বলা হয়েছে।’
নুরুজ্জামানের স্ত্রী সুফিয়া বলেন, ‘আমার স্বামী মিছিলে গিয়ে আহত হয়ে পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আমরা মামলা করিনি। মামলার বাদীকে চিনি না। তাকে মামলা করতে বলিওনি। আমার স্বামীর লাশ না তুলতে আদালতে আমি আবেদন করেছি। শহীদ স্বামীর লাশ তুললে আমি বাঁচব না।’
শহীদ নুরুজ্জামান হত্যা মামলার বাদী আলী হোসেন বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনেরর সময় আমি ঢাকায় ছিলাম। পরে চলতি বছরের জুন মাসে ভাইদের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধের কারণে গ্রামে আসি। ৩০ জুন ভাইদের বিরুদ্ধে জমি নিয়ে মামলা দিতে পাটগ্রাম থানায় গেলে ফক্কর আলী নামে একজন ওসি স্যার তাঁর রুমে নিয়ে যান।
‘তখন ওসি স্যার মামলা নেবেন বলে জানান। এরপর ফক্কর আলী ও একজন পুলিশ একটা কাগজ লিখে এনে আমাকে স্বাক্ষর করতে বললে আমি তা পড়ে দেখতে চাই। কিন্তু ওসি স্যার তা পড়তে দেননি। ওসি স্যার বলেন, আপনার মামলা স্বাক্ষর করেন। কী লেখা আছে, তা স্বাক্ষরের পরে দেখতে পাবেন। আমি স্বাক্ষর করার পর স্যার (ওসি) কাগজটা রেখে দেন।
‘এর তিন দিন পর বিএনপির তিনজন লোক বাড়ি এসে বলেন, আমি কেন তাঁদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছি। তখন আমি বুঝতে পারি, ওসি স্যার ভাইদের বিরুদ্ধে মামলা না নিয়ে নুরুজ্জামান হত্যা মামলার বাদী আমাকে বানিয়েছেন। এখন জীবনের ভয়ে আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি। মামলার আট দিন পর তা প্রত্যাহার করতে বিভিন্ন মহলে আবেদনও করেছি। আমি শহীদ নুরুজ্জামানের কেউ না, তাকে চিনিও না। ঘটনাও জানি না, আসামিদেরও চিনি না।’ মিথ্যে মামলায় তাকে কৌশলে বাদী করা হয়েছে বলেও দাবি করেন আলী হোসেন।
জুলাই আন্দোলনের পাটগ্রাম উপজেলা সমন্বয়ক ও এনসিপির যুগ্ম সমন্বয়কারী কবির আহমেদ রাব্বী বলেন, ৫ আগস্ট পাটগ্রামে আন্দোলন হয়নি, বিজয় মিছিল হয়েছিল। সেখানে পৃথক দুর্ঘটনায় দুজন শহীদ হয়েছে। এ ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবার কোনো মামলা করেনি। বাণিজ্য করতে অপরিচিত ব্যক্তিদের দিয়ে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। এর তীব্র প্রতিবাদসহ নিন্দা জানিয়ে মামলার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন তিনি।
দুই হত্যা মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে দাবি করে পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান বলেন, কাউকে জোর করে মামলা নেওয়া হয়নি। বাদীরা সশরীরে উপস্থিত হয়ে লিখিত দেওয়ায় মামলা নেওয়া হয়েছে। তাঁরা হয়তো কোনো ভয়ে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করতে পারেন।
ক্রাইম জোন ২৪