শিরোনাম
চার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাসালমানের বিগ বসে আসছেন পেহেলগাম হামলায় নিহত নৌসেনার স্ত্রী হিমাংশিএমিরেটসের ফ্লাইটে সব ধরনের পাওয়ার ব্যাংক ব্যবহার নিষিদ্ধযশোর বোর্ডে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেল ২৭১ জনফের বিএনপির মঞ্চে গান গাইলেন পলকের ভগ্নিপতিগাজীপুরে সাংবাদিক তুহিন হত্যার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাআলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিনের বৈঠকে জেলেনস্কিকে রাখার সম্ভাবনাসড়ক ছেড়েছেন শিক্ষার্থীরা, সচল হচ্ছে ঢাকা-উত্তরবঙ্গের যান চলাচলপরিবহন ধর্মঘটের নামে জনগণকে জিম্মি করার পুরোনো খেলা বন্ধ করুন: যাত্রী কল্যাণ সমিতিস্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করায় হত্যার পর লাশ আট খণ্ড: র‍্যাব

নিঃসঙ্গতা দূর করতে দক্ষিণ কোরিয়ায় রামেনের রেস্তোরাঁ খুলেছে সরকার

নিঃসঙ্গতা দূর করতে দক্ষিণ কোরিয়ায় রামেনের রেস্তোরাঁ খুলেছে সরকার

দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী ব্যস্ত সিউল শহরের একটি দোকান ‘ওয়ার্ম-হার্টেড কনভেনিয়েন্স স্টোর’। শুনতে আর দশটা মুদি দোকানের মতো মনে হলেও এই দোকানের পণ্য এক ভিন্ন জিনিস। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য হলেও এই দোকানের পণ্য সব দোকানে মেলে না। স্নেহ, ভালোবাসা, সঙ্গ, সহানুভূতির মতো বিষয়গুলো পেতে এই ‘স্টোর’-এ আসে মানুষ।

২৯ বছর বয়সী হি-কিয়ং। হাসিমুখে এসে দোকানটিতে ঢুকলেন এই তরুণী। প্রতিদিন ‘উষ্ণ হৃদয়ের খোঁজ’-এ এই দোকানে আসেন তিনি। এই দোকানে মেলে বিনা মূল্যের ইনস্ট্যান্ট রামেন নুডলস। সেগুলো খান আর অন্যান্য দর্শনার্থী ও সমাজকর্মীদের সঙ্গে গল্প করতে করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেন।

এই বয়সে অধিকাংশ মানুষকেই ব্যস্ত সময় কাটাতে দেখা যায়। কিন্তু হি-কিয়ংয়ের জীবনের গল্প ভিন্ন।

কৈশোরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন হি-কিয়ং। এখন আর পরিবারের কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই। যেসব বন্ধু আছে, তাদের সঙ্গে পরিচয় অনলাইনে। কে-পপ ব্যান্ড সুপার জুনিয়রকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই বন্ধুত্ব। তবে বন্ধুরা সবাই থাকেন দূরে। বর্তমানে বেকার হি কিয়ং। তাই কর্মস্থলের সহকর্মীও নেই যাদের সঙ্গে গল্প করা যায়। তাঁর সময় কাটে মেঝেতে শুয়ে ফোনে আদুরে প্রাণীর ভিডিও দেখে। কিন্তু এ কাজ আর কতক্ষণ করা যায়!

নিঃসঙ্গতা কাটাতে এখন এই ‘স্টোর’-ই হি-কিয়ংয়ের ভরসা। হি-কিয়ং বলেন, ‘আমি নিজেকে বলি, আরেকটা দিন, আরেকটু নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই দোকানটা না থাকলে আমার আর যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই।’

দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের উদ্যোগে গত মার্চে চালু হওয়ার পর থেকে এ ধরনের চারটি দোকানে ২০ হাজার মানুষ এসেছেন। অথচ প্রথম বছরে মাত্র ৫ হাজার দর্শনার্থী আসবে বলেই ধারণা ছিল।

সিউল শহরের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ডংদেমুন জেলায় অবস্থিত এই শাখায় প্রতিদিন গড়ে ৭০ থেকে ৮০ জন আসেন। যাদের বেশির ভাগই চল্লিশোর্ধ্ব বা পঞ্চাশোর্ধ্ব, তবে হি-কিয়ংয়ের মতো অনেক তরুণ-তরুণীও দোকানের সেবা নিচ্ছেন।

২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, সিউলের ১৯ থেকে ৩৯ বছর বয়সী প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার তরুণ হয় সামাজিকভাবে একাকী, নয়তো স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী হয়ে আছেন। ওই গবেষণায় আরও জানা যায়, রাজধানীতে একক সদস্যের পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশে পৌঁছেছে। এ অবস্থায় বিয়ে ও জন্মহার কমে যাওয়া ঠেকাতে মরিয়া সরকারকে আরও চিন্তায় পড়ে গেছে।

উষ্ণ হৃদয়ের খোঁজে যাত্রা করা এই দোকানে বিবিসির প্রতিবেদক সরেজমিনে দেখেন, প্রায় ১২ থেকে ১৫ জন নারী-পুরুষ, তরুণ-প্রবীণ দর্শনার্থী বেঞ্চে বসে কেউ কেউ বিনব্যাগে হেলান দিয়ে একসঙ্গে সিনেমা দেখছিলেন।

শহরের ‘নিঃসঙ্গতা প্রতিরোধ বিভাগ’-এর ম্যানেজার কিম সে-হন বলেন, ‘আমরা সিনেমা ডে আয়োজন করি, যাতে স্বাভাবিকভাবে একধরনের বন্ধন তৈরি হয়।’

তিনি বলতে থাকেন, দোকানগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে সেখানে সম্পর্কের উষ্ণতা অনুভূত হয়। যেখানে একটি ক্যাফের মতো একটি পরিবেশ পাওয়া যায়।

স্টোরটির এক কোণে এক প্রবীণ নারীকে স্বয়ংক্রিয় ম্যাসাজ চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে দেখা যায়। আরেক কোণে স্তূপ করে রাখা নুডলস দেখা যায়।

ম্যানেজার কিম বলেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় রামেন (নুডলস) হলো ‘স্বস্তি আর উষ্ণতার’ প্রতীক।

নুডলস সেদ্ধ হওয়ার অপেক্ষায় থাকাকালে দর্শনার্থীদের কাছে তাদের মনের অবস্থা ও জীবনযাপনের শর্ত নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত জরিপ ফরম পূরণ করতে বলা হয়।

এই দোকানগুলোতে আসেন নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করা মানুষগুলো। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও তাদের কোনো কিছুতে সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টায় এ উদ্যোগ নিয়েছে শহর কর্তৃপক্ষ।

দক্ষিণ কোরিয়ায় সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তন এসেছে বেশ দ্রুতগতিতে। এক প্রজন্মের মধ্যেই যুদ্ধবিধ্বস্ত কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে এটি রূপ নিয়েছে উন্নত অর্থনীতিতে।

কয়েক দশক আগেও দেশটিতে একই ছাদের নিচে ছয়-আট সন্তানের বড় পরিবার ছিল স্বাভাবিক চিত্র। কিন্তু শহরমুখী অভিবাসনের ধারাবাহিকতায় পরিবার ছোট হয়ে গেছে, আর সিউলের মতো শহর পরিণত হয়েছে বিস্তৃত মহানগরে।

এছাড়াও অসহনীয় বাড়িভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বমূল্য এবং ক্লান্তিকর কর্মঘণ্টা ক্রমশ আরও বেশি তরুণকে বিয়ে বা সন্তান ধারণ অথবা এই দুটোই এড়িয়ে চলার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে আছে একটি অবহেলিত বৃদ্ধ প্রজন্মও রয়ে গেছে যাদের সন্তানরা জীবনজীবিকার দৌড়ে এতটাই ব্যস্ত যে তাদের জন্য সময় নেই।

দোকানের কাউন্সেলর লি ইন-সুক বলেন, ‘একা খাবার খাওয়ার অনুভূতি জীবনের সবচেয়ে নীরস খাবার খাওয়ার মতো। আমি দোকানে আসা প্রবীণদের জিজ্ঞেস করি, তারা ঠিকমতো খাচ্ছেন কি না। শুধু এই প্রশ্ন করলেই তাদের চোখ ভিজে ওঠে।’

ইন-সুক জানান, বিচ্ছেদের পর এবং যখন প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানেরা আলাদা হয়ে গেল, তখন তিনি বুঝতে পেরেছেন নিঃসঙ্গতা কেমন লাগে।

প্রথমবার যখন হি-কিয়ং ওই দোকানে আসেন তখন থেকে ইন-সুকের নজর কাড়েন। হি-কিয়ংয়ের বয়স ইন-সুকের মেয়ের সমান। অনেক দর্শনার্থীর মতো প্রথম দিন হি-কিয়ংও ছিলেন নীরব, প্রায় কারও সঙ্গে কথা বলেননি। কিন্তু দ্বিতীয়বার আসার পর তিনি ইন-সুকের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন।

বাড়তে থাকা ‘নিঃসঙ্গ মৃত্যু’ সিউল কর্তৃপক্ষকে এতটাই উদ্বিগ্ন করেছিল যে তারা এই সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। অনেক প্রবীণ মানুষ বাড়িতে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যাচ্ছিলেন। দিনের পর দিন তাদের মরদেহ ঘরে পড়ে থাকছিল।

শুরুতে এই উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল শুধু ওই সমস্যার সমাধান, কিন্তু পরে তা প্রসারিত হয়ে নিঃসঙ্গতা মোকাবিলার বৃহত্তর অভিযানে রূপ নেয়। তবে সিউল এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম নয়।

২০১৮ সালে যুক্তরাজ্য নিঃসঙ্গতা বিষয়ক মন্ত্রী নিয়োগ দেয়। জাপানও একই পথে হেঁটে একটি সংস্থা গড়ে তোলে, যা কোভিড-১৯ মহামারির সময় সমস্যাটিকে আরও তীব্র বলে চিহ্নিত করে।

অন্যদিকে সমাজ থেকে পুরোপুরি সরে যাওয়ার এই প্রবণতা জাপানে এতটাই সাধারণ যে এর জন্য আলাদা একটি নাম আছে, ‘হিকিকোমোরি’। দক্ষিণ কোরিয়াতেও ক্রমেই তরুণেরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক ও কঠোর সামাজিক বাস্তবতা থেকে।

সিউলের এক ‘নিঃসঙ্গতা প্রতিরোধ কর্মসূচি’র ব্যবস্থাপক লি ইউ-জিয়ং চিন্তিত স্বরে বলেন, ‘হয়তো এর পেছনে মহামারিই দায়ী।’

তিনি বলতে থাকেন, ‘আমার সন্তানেরাও স্মার্টফোনে মুখ গুঁজে থাকে, এমনকি বন্ধুরা বাড়িতে এলেও।’

লি ইউ-জিয়ং আরও বলেন, ‘আজকের দিনে মানুষ বন্ধুত্বের নেটওয়ার্ক তৈরি করাকে কঠিন বলে মনে করে। নিঃসঙ্গতা এখন এমন এক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা সমাজ হিসেবে মোকাবিলা করা দরকার।’

দক্ষিণ কোরিয়া প্রথমে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে একটি হটলাইন চালু করার পদক্ষেপ নেয়, যেখানে মানুষ প্রয়োজনে কারও সঙ্গে কথা বলতে পারে। ২০২৩ সালের এক জাতীয় জরিপে দেখা গেছে, দেশটির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ প্রাপ্তবয়স্কের এমন কেউ নেই, যাকে গৃহস্থালির কাজে সাহায্যের জন্য বলা যায় কিংবা মন খারাপের সময় কথা বলা যায়।

এখানে কাউন্সেলররা যে কারও সঙ্গে যেকোনো বিষয়ে প্রায় ৪০ মিনিট কথা বলার সুযোগ দেন। পার্ক সিউং-আ তার ছোট্ট কিউবিকল থেকে দিনে তিনটি করে কল করেন।

পার্ক আরও বলেন, ‘এত তরুণ-তরুণীরা এই সেশনে অংশ নেয় যে দেখে অবাক হই। তাঁরা নিজেদের কথার ভার ভাগ করে নিতে চায়। বুকে বোঝা হয়ে জমে থাকা কষ্ট ভাগ করে নিতে চায়। বাবা-মা বা বন্ধুদের সঙ্গে প্রায়ই একধরনের দূরত্ব থাকে। তাই তারা আমাদের কাছে আসে।’

এর পর চালু হয় ‘ওয়ার্ম-হার্টেড কনভেনিয়েন্স স্টোর’, যেখানে নিঃসঙ্গরা এসে নিজেদের মনের কথা প্রকাশ করতে পারে।

ডংদেমুন শাখাটি এমন একটি এলাকায় যেখানে নিম্ন-আয়ের মানুষ বেশি থাকে। এসব অ্যাপার্টমেন্টের বেশির ভাগ মানুষই একা বসবাস করে।

৬৮ বছর বয়সী সন সপ্তাহে একবার এই দোকানে আসেন সিনেমা। নিজের ছোট্ট সংকীর্ণ বাসা থেকে কিছুটা সময়ের জন্য মুক্তি পেতে।

তিনি বলেন, ‘এই দোকানগুলো আমার জন্মের আগেই খোলা উচিত ছিল। মাত্র দুই-তিন ঘণ্টা হলেও এখানে সময় কাটানো ভালো লাগে।’

বিয়ে করেননি সন। মায়ের সঙ্গে থাকতেন। মা মারা যাওয়ার পর একা হয়ে পড়েন তিনি। কয়েক বছর আগে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয় তাঁর। এর পর থেকে লাঠি ভর দিয়ে হাঁটেন সন। তিনি বলেন, আমার মতো মানুষের জন্য জায়গা খুব বেশি নেই। যেখানেই যাই, টাকা লাগে। সিনেমা দেখতে গেলেও টাকা লাগে।’

দোকান ব্যবস্থাপক লি বো-হিউন বলেন, এই দোকানগুলো মূলত এমন মানুষের জন্যই তৈরি, যারা অন্য জায়গায় চাইলেই যেতে পারেন না। এগুলো কেবল একটা আড্ডা দেওয়া বা একটি সিনেমা উপভোগ করার জায়গা নয় বরং এর চেয়েও বেশি কিছু। তীব্র গরমের দিনে নিম্ন-আয়ের মানুষদের জন্য বিনা মূল্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশও থাকে, যা তারা নিজেদের ঘরে বহন করতে পারেন না।

এই দোকানগুলোর নাম ‘কনভেনিয়েন্স স্টোর’ দেওয়া হয়েছে যাতে কেউ এখান থেকে সাহায্য চাইতে না ভাবে, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে না লজ্জা পায়। এখনো দক্ষিণ কোরিয়ায় মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সাহায্য চাইতে এখনো অনেকে লজ্জা পান, বিশেষ করে প্রবীণেরা।

দোকানের ম্যানেজার লি জানান, শুরুতে দর্শনার্থীরা প্রায়ই কারও সঙ্গে কথা বলতে বা একসঙ্গে খেতে অস্বস্তি বোধ করেন।

হি-কিয়ংয়ের সেই নতুন আগন্তুক হিসেবে নীরব থাকার দিনগুলোর পর থেকে পেরিয়ে গেছে কয়েক মাস। এখন কেমন সময় কাটছে তাঁর?

এ সময় ইন-সুক বলেন, একদিন স্থানীয় এক পত্রিকার সঙ্গে কথা বলছিলাম। সে সময় নিজের মেয়ের কথা উঠে আসে। হঠাৎ বুকের ভেতর টান অনুভব করেন, গলা কেঁপে ওঠে।’

এ সময় হঠাৎ হি-কিয়ং বলে ওঠে, ‘আমি আপনাকে জড়িয়ে ধরতে চাই।’

ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে হেঁটে এসে সে আলতো করে জড়িয়ে ধরেছিল ইন-সুককে।


ক্রাইম জোন ২৪

আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button