শুধু সংবিধান পরিবর্তন করে দেশকে ভালো অবস্থায় নেওয়া যাবে না: আসিফ নজরুল


আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল মনে করেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যাঁরা অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন, আহত হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন, তাঁদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা প্রদর্শন শুধু সংবিধান পরিবর্তন করে হবে না। সাধারণ মানুষ কেন তখন রাস্তায় নেমে এসেছিল, সেটা উপলব্ধি করে তাঁদের প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশকে একটু ভালো অবস্থায় নিতে প্রয়োজন আত্মসমালোচনা, অন্তর্দৃষ্টি ও প্রকৃত শিক্ষা।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকীতে আজ সোমবার ঢাকার ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
আসিফ নজরুল বলেন, ‘রাষ্ট্রনির্মাণের প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের অনেকরকম ভাবনা আছে। অনেকে মনে করেন, বড় ধরনের সংস্কার দরকার। সংবিধানেই বোধ হয় সমস্ত সমস্যা। আমি তাঁদের সঙ্গে একটু দ্বিমত পোষণ করি।’
একটি ভালো সংবিধান হলেই সবকিছু ভালো হয়ে যাবে কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘আমরা খুব সরলভাবে দেখি বিষয়গুলো। …যারা ভালো হওয়ার কথা বলি, তাঁরা নিজেরা ভালো হয়েছি? শেখ হাসিনার আমলের যে পাপগুলো ছিল মালিকানার রাজনীতি, ট্যাগ দেওয়ার রাজনীতি, অসহিষ্ণুতা, মিথ্যাচার, দুর্নীতি, এগুলো কি দূর করেছি? এগুলো দূর করার জন্য সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে? সত্যি কথা বলার জন্য কি সংবিধান লাগবে? মানুষকে মিথ্যা ট্যাগ দেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য সংবিধান লাগবে? পরমতসহিষ্ণু হতে হলে কি সংবিধান লাগে? একা কোনো কিছুর মালিকানা দাবি করে বাকিদের বঞ্চিত না করতে কি সংবিধান লাগে?’
আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘ভালো সংবিধান ও ভালো আইন প্রয়োজন। কিন্তু সেটাতো মানুষকে উপলব্ধিতে নিতে হবে। নিজের জীবন ও সংস্কৃতিতে বিষয়টি আনতে হবে। নিজেরা ভালো হতে হবে। আত্মসম্মানবোধ থাকতে হবে। প্রকৃত শিক্ষা ও আত্মসমালোচনা প্রয়োজন। এগুলো করলে আস্তে আস্তে গণতন্ত্র ও অনেকগুলো সুষ্ঠু নির্বাচন হলে, এর সঙ্গে প্রকৃত শিক্ষা যদি থাকে, তাহলে এগোনো যাবে।’
জুলাই অভ্যুত্থানে প্রতিটি মানুষ নিজ সিদ্ধান্তে এসেছে, এমনটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নিশ্চিত মৃত্যু জেনে মানুষ গেছে। চিঠি লিখে দিয়ে গেছে। কোথা থেকে এসেছে এত মানুষ। সাধারণ মানুষ। কেন মানুষ গেল, এটা বোঝা খুব জরুরি। এটা বুঝতে পারলে রাষ্ট্রীয় সংহতি, সংস্কার ও রাষ্ট্রগঠন অনেকটা সহজ হয়ে যেতো।’
শেখ হাসিনাকে নিয়ে বিস্ময় কখনো শেষ হওয়ার নয়— এমনটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভোটে কারচুপিসহ বিভিন্ন অপরাধ হাসিনার আগে এইচ এম এরশাদ ও খালেদা জিয়াসহ সবার সময়ই কিছু হয়েছে। কিন্তু হাসিনা তিনটি নির্বাচনে ভোটের অধিকার থেকে মানুষকে যেভাবে বঞ্চিত করেছে, মানুষের সঙ্গে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে, মিথ্যাচার করেছে, লাশ গুম করেছে, লুটপাট ও দুর্নীতি করেছে, তাতে সে সবকিছুতে মাত্রা ও ব্যাপকতায় আগের সকল শাসক ও শাসনামলকে ছাড়িয়ে গেছেন। একটি মানুষ কীভাবে এসব করতে পারে, সে বিষয়ে তাঁর (হাসিনার) ওপর স্নায়বিক (নিউরোলজিকাল) ও মনস্তাত্ত্বিক ও অন্যান্য দিক থেকে পিএইচডি (গবেষণা) হওয়া উচিত।
আসিফ নজরুল বলেন, শেখ হাসিনা বলতেন, তিনি ভারতকে এত কিছু দিয়েছেন যে ভারত ভুলতে পারবে না। যেন তিনি তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি দিয়েছে। সে বাংলাদেশকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভাবত। বাংলাদেশের সকল মানুষকে তাঁর ক্রীতদাস ভাবত। একপর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে জুলাইয়ে গণঅভ্যুত্থানের সময় প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ সিদ্ধান্তে এসেছেন। এ গণঅভ্যুত্থানের রূপকার ছিল বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ।
সবুজ পাসপোর্টে (বাংলাদেশের) বিদেশের ভিসা চাইলে ও বিদেশের বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন অফিসার তাচ্ছিল্যের চোখে তাকাবে না, এমনটা নিজের জীবনে দেখে যেতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটা হবে একটা লক্ষণ, আসলে বাংলাদেশ কতটা এগোতে পারল নিজে নিজে বড় হয়ে যাওয়ার আত্মতৃপ্তিতে ভুগে কোনো লাভ নেই।’
বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা অনেক সময় দেশের ভেতরকার বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন, আইন উপদেষ্টার এ মন্তব্যের সঙ্গে ‘আংশিক একমত’ পোষণ করেন সেমিনারের বিশেষ অতিথি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, চাকরির বেশিরভাগ সময় বিদেশে থাকার কারণে এটা হয়ে থাকতে পারে। সবুজ পাসপোর্টের দুরবস্থা কাটাতে হলে জাল কাগজপত্র দেওয়া ও নিজেকে অকারণে ছোট করা বন্ধ করতে হবে।
পররাষ্ট্রসচিব আসাদ আলম সিয়াম সেমিনারে সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমির রেক্টর ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম ও মন্ত্রণালয়ের জনকূটনীতি বিভাগের মহাপরিচালক শাহ আসিফ রহমান বক্তব্য রাখেন। সেমিনারে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ওপর একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।