এনসিপি কিংস পার্টি, কারণ তাদের দুই সহযোদ্ধা সরকারে: টিআইবি প্রধান


নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিকে কিংস পার্টি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)। সংস্থাটির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল বা কিংস পার্টি গঠন করা হয়েছে।
আজ সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরাম ও মো. জুলকারনাইন।
এ সময় একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, এই কিংস পার্টি কারা। জবাবে টিআইবির নির্বাহী প্রধান ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটা গোপন করার কিছুই নেই। এটি জাতীয় নাগরিক পার্টি, তার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে কিংস পার্টি। কারণ, এর সঙ্গে সহযোদ্ধা বা সহযাত্রী হিসেবে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে দুজন সরকারে এখন আছেন। সে হিসেবে কিংস পার্টি।’
৫ আগস্টের পরবর্তী রাজনৈতিক যাত্রা অশুভ ছিল বলে মন্তব্য করেন ইফতেখারুজ্জামান। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘ওই দিন বিকেল থেকেই বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের একাংশ দলবাজি, চাঁদাবাজি, মামলা–বাণিজ্য শুরু করে এবং গত এক বছর ধরে তা আরও বেড়েছে। এমনকি দলের উচ্চপর্যায় থেকে ব্যবস্থা নিয়েও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এর ফলে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের জন্মলগ্ন থেকে একই রোল মডেল অনুসরণ করেছে। দখলবাজি, চাঁদাবাজির মধ্যে নিজেদের নিমজ্জিত করে আত্মঘাতী পথে অগ্রসর হয়েছে।’
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের দখলে থাকা ঢাকা শহরের ৫৩টি পরিবহন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন ২ কোটি ২১ লাখ টাকা চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া সিলেটের কোয়ারি ও নদ-নদী থেকে পাথর লুটপাট; সেতু, বাজার, ঘাট, বালুমহাল, জলমহাল ইত্যাদির ইজারা নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়েছে। করা হয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনৈতিক মামলা।
গবেষণা প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণে টিআইবি জানায়, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রভাব গত এক বছরে অনেক বেশি বেড়েছে। তথ্য প্রকাশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এখনো বাধার মুখে রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতা ও বলপ্রয়োগের কারণে নারীর অধিকার, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে, যা বৈষম্যবিরোধী চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারে তথ্য প্রকাশে সমন্বয়হীনতা ও গোপনীয়তার প্রবণতা রয়েছে। ভারতের অবন্ধুসুলভ আচরণের ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সংকট ও তার ফলে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব অব্যাহত। টিআইবি মনে করে, রাখাইনে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারের অস্পষ্ট অবস্থান ও তথ্য প্রকাশে ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অবন্ধুসুলভ আচরণ, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ; সীমান্তে হত্যা ও ‘পুশ ইন’ অব্যাহত; বাণিজ্যে বাধা আরোপ; কূটনৈতিক টানাপোড়েন; শেখ হাসিনার প্রত্যার্পণ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না জানানোও সরকারের ঘাটতি বলে মনে করে টিআইবি।
এক বছরের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে প্রতিবেদনে জানানো হয়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। অব্যাহত রয়েছে খুন, ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ, আন্দোলন, লুটপাট, অরাজকতা। আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা (মব জাস্টিস’) গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনার আশংকাজনক বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢালাওভাবে মামলায় আসামী হিসেবে নাম দেওয়া, গ্রেপ্তার বাণিজ্যের অভিযোগ, রাজনৈতিক চাপ বাড়লে গ্রেপ্তার বৃদ্ধির অভিযোগ বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে মৃত্যু অব্যাহত আছে। আন্দোলন দমন করতে পুলিশের কার্যক্রমে বৈষম্য কোনো পক্ষের প্রতি নমনীয় মনোভাব, কোনো পক্ষের ওপর নির্যাতন হয়েছে।
টিআরবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংস্কার কমিশনগুলো নিয়ে বৈষম্য আছে। প্রথম গঠিত কমিশনগুলোর প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হলেও পরে গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশ গুরুত্ব পায়নি। জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য সত্ত্বেও যেসব সংস্কারে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোর সাংবিধানিক ও আইনগত বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সে প্রশ্ন এখনো অনিশ্চিত। ফলে সংস্কারের আশায় ধাক্কা লাগতে পারে এবং রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে বলে মনে করে টিআইবি।