একটি সাধারণ হ্যান্ডব্যাগের দাম ৯২ লাখ ডলার, কতটা যৌক্তিক


‘আমি আমার টাকা-পয়সা আলমারিতে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে চাই।’ —জনপ্রিয় টেলিভিশন সিরিজ সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি-তে বিখ্যাত এই কথা বলেছিলেন ক্যারি ব্র্যাডশো। যার অর্থ তিনি টাকা জমাতে চান না। প্রচুর জামা-কাপড়, জুতা, ব্যাগ কিনে আলমারি ভরে ফেলতে চান। বর্তমান সময়ে এসে এই উদ্ধৃতির আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কারণ, দিনকে দিন ক্রমবর্ধমান সংখ্যক সংগ্রাহকই ফ্যাশনকে বিনিয়োগযোগ্য শিল্প হিসেবে বিবেচনা করছেন, এবং আর্কাইভাল বা সংগ্রহযোগ্য ফ্যাশন পণ্য এখন নিলামে বিক্রি হচ্ছে রেকর্ড মূল্যে।
গত মাসেই, প্যারিসে নিলামঘর সোথবির একটি নিলামে ব্রিটিশ-ফরাসি অভিনেত্রী ও গায়িকা জেন বারকিনের ব্যবহৃত একটি পুরোনো ও নষ্ট হয়ে যাওয়া হারমেস ব্যাগ বিক্রি হয়েছে ৭০ লাখ পাউন্ডে (প্রায় ৯২ লাখ মার্কিন ডলার)। এই প্রতিবেদন লেখার সময় লন্ডনে চলছে সোথবির আরও একটি নিলাম। বিলাসবহুল পপ-আপ নিলামঘরে তোলা হয়েছে হারমেস, রোলেক্স এবং কার্টিয়েরের মতো অভিজাত ব্র্যান্ডের পণ্য। এ নিলাম চলবে ২২ আগস্ট পর্যন্ত।
তবে এমন চিত্র আগে ছিল না। ঐতিহ্যগতভাবে অধিকাংশ নিলামঘর ফ্যাশন বিভাগকে মূল নিলাম কাঠামোর বাইরে বা পরিপূরক হিসেবে বিবেচনা করত। তাদের মূল লক্ষ্য থাকত উচ্চমূল্যের চিত্রকর্ম বা ভাস্কর্যের দিকে ক্রেতাদের মনোযোগ ফেরানো।
প্রথাগতভাবে তারকাদের ব্যবহৃত পোশাক, যেমন—প্রিন্সেস ডায়ানা বা মেরিলিন মনরোর পোশাক বেশি দামে বিক্রি হলেও, জেন বারকিনের ব্যাগের মতো নজির অতীতে দেখা যায়নি। মনরোর বিখ্যাত ‘হ্যাপি বার্থডে মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ গাউনটি ১৯৯৯ সালে ১৩ লাখ ডলারে এবং ২০১৬ সালে ‘রিপলি’স বিলিভ ইট অর নট!’ মিউজিয়ামের কাছে ৪৮ লাখ ডলারে বিক্রি হয়। বর্তমানে এই পোশাক মিউজিয়ামে সংরক্ষিত থাকলেও, ২০২২ সালে এটি পরে মেট গালায় অংশ নেন কিম কার্দাশিয়ান।
ফ্যাশন ইতিহাসবিদ ও লেখক কোরা হ্যারিংটনের মতে, যদিও ব্যবহারে পোশাকের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে তবু কিম কার্দাশিয়ান এই পোশাক পরায় এর ভবিষ্যৎ নিলামমূল্য আরও বাড়বে। তিনি বলেন, ‘যদিও এটি মেরিলিন মনরোর পোশাক হওয়ায় এর দাম এমনিতেই বেশি থাকত, তবুও কিম কার্দাশিয়ানের অগণিত অনুসারী হয়তো এর দাম আরও বাড়িয়ে তুলবেন। সাধারণত পোশাক ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটির মূল্য কমে যায়, তবে এই ক্ষেত্রে ঘটছে ঠিক উল্টোটা।’ তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং গণমাধ্যমে কোনো পণ্যের বিষয়ে আলোচনাও (তা প্রশংসামূলক হোক বা সমালোচনামূলক যা-ই হোক) নিলামে তার দামের ওপর প্রভাব ফেলে। যেমন, রায়ান মারফির আসন্ন টিভি সিরিজ ‘আমেরিকান লাভ স্টোরি’-তে ক্যারোলিন বেসেট কেনেডির পোশাক পুনরায় আলোচনায় আসায়, পরবর্তী নিলামে তাঁর পোশাকের মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
এই প্রসঙ্গে হ্যারিংটন বলেন, আধুনিক যুগের অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সাররা বিলাসবহুল ফ্যাশনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছেন। ‘ডিউপ’ (কপি) সংস্করণ খোঁজার জন্য গড়ে ওঠা অনলাইন কমিউনিটিগুলোও মূল পণ্যের প্রতি চাহিদা বাড়িয়েছে। ম্যাক্স পন লাক্সারির প্রেসিডেন্ট মাইকেল ম্যাক বলেন, ‘ডিউপ সংস্করণ জনপ্রিয় হলেও, তা আরও মানুষকে আসল জিনিস কিনতে আগ্রহী করছে। এখন শুধু গুচ্চি, হারমেস বা শ্যানেল নয়, আমরা কোচ, মাইকেল কোরস, কেট স্পেডের ব্যাগও বিক্রি করি, যার মূল্য ৩০০ থেকে ৫০০ ডলারের মধ্যে।’ তিনি যোগ করেন, শুধু উচ্চমূল্যের হিমালয়ান কুমিরের চামড়ার হীরকখচিত ব্যাগ নয়, মাঝারি দামের ব্যাগের চাহিদাও যথেষ্ট, এবং সেটিই মূলধারার ব্যবসা।
তবে ফ্যাশন পণ্য কেনাবেচার বর্তমান প্রবণতা নিয়ে সতর্ক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের উইচিটা স্টেট ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিভাগের ডব্লিউ ফ্র্যাঙ্ক বার্টন চেয়ার অধ্যাপক উষা হ্যালি। তাঁর মতে, পুনরায় বিক্রির উদ্দেশ্যে স্বল্পমেয়াদি লাভের আশায় যদি বিনিয়োগকারীরা ধারাবাহিকভাবে বিলাসবস্তু ক্রয় কিনে থাকেন, তাহলে তা গোটা বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে এবং বাজারমূল্যের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
হ্যালি বলেন, ‘ফ্যাশন পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটিকে সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রকাশ বা শিল্প হিসেবে না দেখে কেবলই বিলাসিতার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, যা মূলত অভিজাত শ্রেণির হাতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে, যদিও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কিছুটা গণপ্রবেশের সুযোগ তৈরি হয়েছে।’
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিস্তারের ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ঐতিহাসিক পোশাক ও পুরোনো স্টাইল আইকনের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টের কস্টিউম ইনস্টিটিউটের প্রদর্শনী ও মেট গালা অনুষ্ঠান এসব আগ্রহ আরও উসকে দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন বিতর্ক দেখা দিয়েছে—বহুমূল্য, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন ফ্যাশন পণ্যগুলোর স্থান কি ব্যক্তিগত সংগ্রহে হওয়া উচিত, নাকি সেগুলোর সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের দায়িত্ব থাকা উচিত জাদুঘরের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে?
ফ্যাশন ইতিহাসবিদ কোরা হ্যারিংটন এ বিষয়ে বলেন, ‘আজকাল অনেক ব্যক্তিগত সংগ্রহ এমন পেশাদার সংস্থার তত্ত্বাবধানে রাখা হয়, যাদের সংরক্ষণ নীতিমালা অনেক ক্ষেত্রেই জাদুঘরের চেয়েও উন্নত।’ তিনি নিউ ইয়র্কভিত্তিক সংস্থা ইয়োভোর কথা উল্লেখ করে বলেন, তাদের সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা সর্বোচ্চ মানের।
তবে হ্যারিংটনের মতে, পোশাকের মৌলিক উদ্দেশ্যই হচ্ছে পরিধান। তা শুধুই প্রদর্শনের বস্তু হয়ে উঠলে প্রাণ হারিয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে তিনি জেন বারকিনের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন, যিনি তাঁর হ্যান্ডব্যাগটিকে ভালো মতোই ব্যবহার করেছেন। ব্যবহারের স্পষ্ট চিহ্নও ব্যাগটির গায়ে রয়েছে। হ্যারিংটন বলেন, ‘এটাই তাঁর সত্যিকারের মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে। পোশাক সংগ্রহ করা যেতে পারে, কিন্তু পোশাক তো মূলত পরিধানের জন্য বানানো। এটিকে পরুন, ব্যবহার করুন, উপভোগ করুন।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ফ্যাশন নিছক পোশাক নয়—এটি এক ধরনের পরিধেয় শিল্প। তবে অনেকেই এখনো ফ্যাশনকে প্রচলিত অর্থে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অনাগ্রহী। তাঁদের মতে, ফ্যাশনের কোনো পণ্য কখনো চিত্রশিল্পী পিকাসোর আঁকা চিত্রকর্মের মতো উচ্চমূল্যে বিক্রি হওয়া উচিত নয়।
তবে এই ধারণাকে কাঠামোগত পক্ষপাতের ফল বলে মনে করেন ফ্যাশন ইতিহাসবিদ কোরা হ্যারিংটন। তিনি বলেন, ‘এমন বিশ্বাসের পেছনে রয়েছে গভীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পক্ষপাত। নারীদের কাজ, নারীদের আগ্রহ বা রুচিকে ঐতিহ্যগতভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ বা কম মূল্যবান হিসেবে দেখা হয় বলেই ফ্যাশনকে অনেকেই শিল্পের মর্যাদা দিতে চান না।’
একই সঙ্গে, ফ্যাশনের মূল উদ্দেশ্যকে বিলাসবস্তু বা বিনিয়োগের সামগ্রীতে রূপান্তরিত করার ঝুঁকি নিয়েও সতর্ক করেন বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাষ্ট্রের উইচিটা স্টেট ইউনিভার্সিটির ডব্লিউ ফ্র্যাঙ্ক বার্টন আন্তর্জাতিক ব্যবসা চেয়ার অধ্যাপক উষা হ্যালি বলেন, ‘ফ্যাশন যখন কেবল বাজারমূল্য বা মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে, তখন সেটির ভেতরের সৃজনশীলতা, কারিগরি উৎকর্ষ, শ্রমজীবীদের অধিকার বা নারীদের অবদান—সবকিছুই আড়ালে চলে যায়। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ফ্যাশনকে একটি জটিল সাংস্কৃতিক শিল্প না ভেবে কেবল দামি পণ্যে পরিণত করছে।’
তবে এটিও অনস্বীকার্য যে, বহু ফ্যাশন পণ্যের পেছনে রয়েছে অসাধারণ কারিগরি দক্ষতা, দশকের অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্যবাহী ফ্যাশন হাউসগুলোর শতাব্দীব্যাপী কর্মযজ্ঞ। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৯ সালে জ্যঁ পল গতিয়েরের ডিজাইন করা ডেনিম ও উটপাখির পালক দিয়ে তৈরি একটি গাউন ৭১ হাজার ৫০০ ইউরোতে (প্রায় ৬১ হাজার ৯০০ পাউন্ড) বিক্রি হয়েছে, যা এই শিল্পে সময়, মেধা ও পরিশ্রমের মূল্য নির্দেশ করে।
এই প্রেক্ষাপটে হ্যারিংটন বলেন, ‘নিলামের মূল দর্শনই হচ্ছে, যে বস্তুর জন্য যতটুকু মূল্য কেউ দিতে রাজি, সেটির প্রকৃত মূল্য ততটাই। যদি কোনো পোশাক ৩ লাখ ডলারে বিক্রি হয়, তাহলে সেটিই তার বাজারমূল্য।’