ইরান নয়, মধ্যপ্রাচ্যের আতঙ্ক এখন লাগামহীন নেতানিয়াহু


ইরানে ইসরায়েলি আগ্রাসনের পর দীর্ঘমেয়াদি টানাপোড়েন তৈরির ঝুঁকি বাড়ছে মধ্যপ্রাচ্যে তেল আবিরের ‘মিত্র’ বা বন্ধু ভাবাপন্ন দেশগুলোতে। এমন আশঙ্কাই প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্ট উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর কর্মকর্তারা।
ইসরায়েল একসময় ইরানের পারমাণবিক হুমকির বিরুদ্ধে প্রধান নিরাপত্তা গ্যারান্টর হিসেবে বিবেচিত হলেও, এখন ইসরায়েলকেই সবচেয়ে বড় অস্থিরতার উৎস হিসেবে দেখছেন আরব দেশগুলোর অনেকেই। তেহরানের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর পর ইসরায়েলের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ আরও বেড়েছে।
এক আরব কূটনীতিক ইসরায়েলের এই হামলাকে আখ্যা দিয়েছেন ‘অমার্জনীয় বেপরোয়া পদক্ষেপ’ হিসেবে। যদিও কিছু কর্মকর্তা চেয়েছিলেন, ইসরায়েল যেন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। তারপরও উপসাগরীয় অঞ্চলের তিনটি দেশের প্রতিনিধিরা ইসরায়েলের সামরিক আধিপত্য এবং দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর তা ব্যবহারের প্রবণতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আরব কর্মকর্তা বলেন, ‘গাজা, লেবানন, সিরিয়া ও এখন ইরান—সবখানেই তিনি (নেতানিয়াহু) নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণহীন, লাগামছাড়া শক্তি আর আমাদের জন্য সম্পদ নয়। এটি এখন আমাদের জন্য সমস্যা।’
ইসরায়েলের ‘অস্থিতিশীল’ ভূমিকা নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে আব্রাহাম অ্যাকর্ডস। এই ঐতিহাসিক চুক্তির মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদান ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিল। দশকব্যাপী শত্রুতার অবসান ঘটিয়ে ইসরায়েলকে আরব বিশ্বের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি ছিল বড় সাফল্য। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের অন্যতম বড় কূটনৈতিক অর্জনও ছিল এই চুক্তি।
মার্কিন কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন, সৌদি আরবও শেষ পর্যন্ত এই পথ অনুসরণ করবে। কিন্তু গাজা যুদ্ধের পর রিয়াদের কড়া সমালোচনার কারণে সেই আশায় ভাটা পড়েছে। উপসাগরীয় দেশগুলো এই চুক্তির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল মূলত ইরানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে। তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন ও মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর পৃষ্ঠপোষকতাকে অঞ্চলটির প্রধান হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক ভূমিকায় শিথিলতার প্রেক্ষাপটে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও সামরিক সহযোগিতার সুযোগও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ইরানের জায়গায় ইসরায়েলই অস্থিতিশীলতার প্রধান উৎস হয়ে উঠছে। এটি এক ধরনের তিক্ত বিদ্রূপ।
ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজতে আগ্রহী উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছে ইসরায়েলের সীমাহীন সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এখন বড় উদ্বেগের কারণ। দুবাইভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা’হুত-এর মহাপরিচালক মোহাম্মদ বাহারুন বলেন, ‘ইসরায়েলের যেকোনো দেশ আঘাত করার সক্ষমতা রয়েছে।’
বাহারুন প্রশ্ন তোলেন, ‘তারা (ইসরায়েল) যদি ইরানের সঙ্গে আমাদের যে গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে সেখানে আঘাত করে? কাতার দীর্ঘদিন ধরে হামাসের রাজনৈতিক দপ্তর রাখার কারণে ইসরায়েলের ক্ষোভের কারণ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কি কাতারকেও ছাড় দেবে?’
তিনি আরও বলেন, ‘ইসরায়েলের লাগামছাড়া সামরিক শক্তি এখন গোটা বিশ্বের জন্যই খারাপ খবর। আগে আমি ইসরায়েলিদের বলতাম, আমরা শান্তির অংশীদার হতে চাই। কিন্তু তারা শুধু নিরাপত্তার অংশীদার হতে চাইত। এখন তারা সেটারও অংশীদার না। তারা এখন স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।’
উপসাগরীয় দেশগুলোর রাজধানীগুলোতে এসব উদ্বেগের প্রকাশ থাকলেও, প্রকাশ্য বিবৃতি আর ব্যক্তিগত অবস্থানের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। ইসরায়েলের ইরান হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে ‘ভ্রাতৃপ্রতিম ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে স্পষ্ট আগ্রাসন’ বলে নিন্দা জানায়। ওমানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আল-বুসাইদি ইসরায়েলি হামলাকে ‘অবৈধ’ এবং ‘অযৌক্তিক’ বলেন।
কিন্তু বেসরকারিভাবে কিছু সরকারি কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, ইসরায়েল যদি সত্যিই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করতে সক্ষম হয়ে থাকে, তাহলে সেটাই সবার জন্য সবচেয়ে ভালো ফলাফল। কারণ এতে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সংঘাতে জড়ানোর ঝুঁকি কমেছে।
ইসরায়েল এরই মধ্যে হামাস ও হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরানের প্রক্সি নেটওয়ার্ক দুর্বল করে দিয়েছে। তারা আশা করছে, হয়তো এবার ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিরও ঘাঁটি ভেঙে দিয়েছে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক উপসাগরীয় দেশের কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা সবাই একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারব। ইসরায়েল আমাদের আশপাশটা পরিষ্কার করছে। এ জন্য কিছুটা কৃতজ্ঞতাও থাকা উচিত।’
তবে উদ্বেগও রয়েছে। কেউ বিশ্বাস করেন না যে, ইসরায়েল-ইরানের যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী হবে। ফলে একের পর এক সংঘাতের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। এতে গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এমনকি যারা ইসরায়েলের পদক্ষেপে গোপনে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন, তারাও এই লাগামছাড়া সামরিক আধিপত্যের দীর্ঘমেয়াদি ফল নিয়ে গভীর শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বেলজিয়ামের ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংকট বিশ্লেষক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ গবেষক ইয়াসমিন ফারুক বলেন, ‘ইরানের দুর্বলতা আমাদের কাছে স্বাগত। কিন্তু এর মূল্য যদি হয় আরও অস্থিতিশীলতা, আরও বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা—বিশেষ করে যখন কূটনৈতিক সমাধানের পথ কাজ করছিল—তাহলে এই মূল্য খুব বেশি হয়ে যাবে।’
এখানে বিদ্রূপ স্পষ্ট। বছরের পর বছর উপসাগরীয় কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনের কাছে, এমনকি গোপনে ইসরায়েলের কাছেও অনুরোধ করে এসেছেন, যেন তারা আগাম হামলা চালায়। তাদের ভাষায়, ‘সাপের মাথা কেটে ফেলা’ দরকার ছিল। কিন্তু কৌশলগত হিসাব পাল্টে গেছে। ২০১৯ ও ২০২২ সালে সৌদি ও আমিরাতের জ্বালানি স্থাপনায় সন্দেহভাজন ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র সামরিক প্রতিক্রিয়া না দেখানোয় উপসাগরীয় দেশগুলো হতাশ হয়।
এদিকে, দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ অগ্রাধিকারও বদলেছে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটিকে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করার বড় পরিকল্পনা নিয়েছেন। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অবস্থানকে পেছনের সারিতে ঠেলে দিয়েছেন তিনি।
ইরানের বিরুদ্ধে সৌদি অবস্থান নিয়ে ইয়াসমিন ফারুক বলেন, ‘মূলত সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ অগ্রাধিকারই তাদের ইরানের সঙ্গে মীমাংসার পথে ঠেলে দিয়েছে। এখন তারা সামরিক হামলার বিপক্ষে, এমনকি সীমিত হামলারও, যা আগে হয়তো গ্রহণযোগ্য ছিল। এমনকি তারা এখন আর ইরানে সরকার পতনের নীতিও সমর্থন করে না।’
সংযুক্ত আরব আমিরাত তুলনামূলকভাবে কঠোর অবস্থানে থাকলেও, তারা ২০২৩ সালে চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি-ইরান সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের বিরোধিতা করেনি। মোহাম্মদ বাহারুন বলেন, ‘এই সমঝোতার পর ইরানের সামনে আর কোনো প্রকাশ্য শত্রু থাকেনি।’
এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের আচরণ রিয়াদে বিশেষ অসন্তোষ তৈরি করেছে। চলতি বছরের এপ্রিলে সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী তেহরানে যান। ১৯ বছরের মধ্যে এটাই ছিল কোনো শীর্ষ সৌদি কর্মকর্তার প্রথম তেহরান সফর। সেখানে তিনি নাকি ইরানকে আশ্বস্ত করেছিলেন, ইসরায়েল তাদের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর সম্ভাবনা নেই।
উপসাগরীয় অঞ্চলের উদ্বেগের কারণও স্পষ্ট। ওয়াশিংটনের মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের সহযোগী ফেলো ড্যানিয়েল বেনায়িম বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের নতুন স্পার্টা এখন ইসরায়েল, যাদের পেছনে আছে যুক্তরাষ্ট্র। এমন সামরিক আধিপত্য এবং বাস্তবতা বদলাতে হামলা চালানোর ইচ্ছা অত্যন্ত শক্তিশালী ব্যাপার।’
অনেক উপসাগরীয় কর্মকর্তাই ইসরায়েলকে দোষারোপ করছেন। কারণ, দেশটি যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেছে। উপসাগরীয় কর্মকর্তারা মনে করতেন, এতে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত হলে ইরানের পাল্টা প্রতিশোধের ঝুঁকি বাড়াবে। বিশেষ করে, আরব দেশগুলোতে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটি, জ্বালানি স্থাপনা ও বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর।
এই ভয় যে ভিত্তিহীন ছিল না, তা প্রমাণ হয়েছে। ইরান কাতারের আল-উদেইদ মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। তবে হামলাটি ছিল সীমিত, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী। ফলে উপসাগরীয় নেতাদের সবচেয়ে বড় ভয়—অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও ধনী বিদেশিদের দেশত্যাগ—এখনো বাস্তব হয়নি।
ইসরায়েল নিশ্চিতভাবেই ইরানের প্রক্সি নেটওয়ার্ক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতার ‘বড় অংশ’ ধ্বংস করেছে। এতে অঞ্চল কিছুটা নিরাপদ হয়েছে বলা যায়। কিন্তু উপসাগরীয় কর্মকর্তারা জানেন, বাকি যে হুমকিগুলো রয়েছে—ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী, ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া ও ইরানের স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র—সবই তাদের দোরগোড়ায়।
অবশ্য গোটা অঞ্চল সব সময় এক কণ্ঠে কথা বলে না। ড্যানিয়েল বেনায়িম বলেন, ‘যেসব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, তারা হয়তো এই শক্তিশালী মিত্রকে পাশে পাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি অনুভব করছে। আর যারা কূটনৈতিক সমঝোতা ও উত্তেজনা প্রশমনের ওপর জোর দিচ্ছে—যেমন ওমান, কুয়েত—এবং যারা ইসরায়েলের সঙ্গে খুব বেশি সম্পর্ক তৈরি করেনি, তারা ইসরায়েলের এই নতুন কৌশলগত সক্রিয়তা ও কর্তৃত্ব নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন।’