অতিরিক্ত খরচে ঋণছাড়ের ছক


কারিগরি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ‘টিভিইটি টিচার্স ফর দ্য ফিউচার (টিটিএফ)’ নামক একটি প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয়ের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) দেবে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, বাকি অংশ সরকারের। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের মতে, প্রকল্পটি ১ হাজার ২০০ কোটি টাকায়ও বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল। সংশ্লিষ্টরা জানতে চেয়েছেন, প্রস্তাবিত ব্যয়ের বাকি টাকা কোথায় যাবে। তদন্তে ধরা পড়েছে, মূল কৌশল হলো বাস্তব চাহিদার চেয়ে বেশি খরচ দেখিয়ে এডিবির ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার পুরোটাই ছাড় করানো।
চার বছরের মেয়াদে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নেওয়া প্রকল্পটি আজ মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য তোলা হচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১২তম, একই সঙ্গে শেষ একনেক সভাটি হবে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের কমিশন চত্বরে এনইসি কক্ষে। এই প্রকল্পের সঙ্গে আরও নতুন ১১টি, সংশোধিত ৬টিসহ মোট ১৭টি প্রকল্প উঠছে। সব মিলিয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৭৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৩ হাজার ১৮০ কোটি ৩৪ লাখ, বৈদেশিক ঋণ ৫ হাজার ৫৬৩ কোটি ৪৩ লাখ এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ২৩০ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
সভায় সভাপতিত্ব করবেন প্রধান উপদেষ্টা ও একনেকের চেয়ারপারসন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। উপস্থিত থাকবেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ; আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলসহ অন্যান্য উপদেষ্টা ও কর্মকর্তা।
টিটিএফ প্রকল্পের সবচেয়ে বিতর্কিত খাত ভবন নির্মাণ। সাধারণভাবে প্রতি বর্গমিটার খরচ ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে থাকে। কিন্তু এখানে অনাবাসিক ভবনের জন্য ধরা হয়েছে ৬৮ হাজার ৯৮৫ টাকা এবং আবাসিক ভবনে ৬৭ হাজার ৫৭৪ টাকা। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডেস্ক-৪) নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেছেন, এ ধরনের ভবনের ব্যয় সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকার মধ্যে হওয়া উচিত।
বিদেশে প্রশিক্ষণেও অস্বাভাবিক খরচ দেখানো হয়েছে। ৩৭৮ জন কর্মকর্তার জন্য বরাদ্দ ৬৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা, অর্থাৎ প্রতিজনের জন্য ১৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা। দেশে যখন বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে, তখন এ ব্যয় যৌক্তিক নয় বলে মনে করছেন পরিকল্পনাবিদেরা।
পরামর্শক খাতেও রাখা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা, যদিও সরকারি জনবল দিয়েই এ কাজ সম্ভব ছিল।
এই প্রকল্প ঘিরে আগে পরিকল্পনা কমিশনের সভায় আপত্তি তোলা হয়েছিল। কথা ছিল ব্যয় কমানো হবে। কিন্তু সংশোধিত প্রস্তাবেও চিত্র একই রয়ে গেছে, কিছু খাতে বরং খরচ আরও বাড়ানো হয়েছে।
অস্বাভাবিক ব্যয় নিয়ে জানতে চাওয়া হলে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত সচিব আব্দুর রউফ আজকের পত্রিকাকে বলেছিলেন, ‘পিইসি সভায় ব্যয় যৌক্তিক করা হবে। ভবন নির্মাণে অতিরিক্ত খরচ থাকবে না। সভা শেষে দেখবেন, এসব খরচ আর থাকবে না।’ কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, প্রকল্পটি কাটছাঁট ছাড়াই এগোচ্ছে। যেসব খাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের অভিযোগ ছিল, সেগুলো রেখেই এখন অনুমোদনের পথে। ফলে কর্মকর্তার আশ্বাস ও বাস্তব চিত্রের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য দেখা দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পের নামে যখন অপ্রয়োজনীয় খরচ দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা যুক্ত করা হয়, তখন আসল উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ জাগে। টেকনিক্যাল শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ অবশ্যই দরকার, কিন্তু তার নামে ব্যয়বহুল পরিকল্পনা করে ঋণের পুরো অর্থ ছাড় করানোর চেষ্টা দুর্নীতির ইঙ্গিত দেয়।