‘হরমুজ প্রণালি’ বন্ধ হলে দাম বাড়বে জ্বালানির


ইরান ও ইসরায়েলের চলমান সংঘাতে মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্ব অর্থনীতিতে উত্তেজনা বাড়ছে। দ্রুত সংকট সমাধান না হলে যেকোনো সময় ‘হরমুজ প্রণালি’ বন্ধের হুমকি দিয়েছে ইরান। জ্বালানি তেল সরবরাহে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক এই বাণিজ্যপথ বন্ধ হলে জ্বালানির বৈশ্বিক বাজার আরও অস্থির হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এতে আমদানিনির্ভর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের জ্বালানি খাতও বড় সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন তাঁরা।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ) বলছে, হরমুজ প্রণালি দিয়ে পরিবাহিত জ্বালানি তেলের প্রায় ৭০ শতাংশেরই ভোক্তা চীন, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, ফিলিপাইন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাও সরাসরি মধ্যপ্রাচ্য থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে।
ফলে হরমুজ প্রণালিতে যেকোনো ধরনের প্রভাবের প্রতিক্রিয়া এসব দেশের জ্বালানি তেলের বাজারেও পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) এক প্রতিবেদন অনুসারে, এই পথ দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি ১০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিবাহিত হয়, যা বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ২১ শতাংশ।
বাংলাদেশের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির প্রধান উৎস কাতার ও ওমান। এই দুই দেশ থেকে আমদানির সিংহভাগ এলএনজিই হরমুজ প্রণালি হয়ে আসে। ফলে এই রুট বন্ধ হলে বাংলাদেশের গ্যাস সরবরাহে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, এলএনজি আমদানিতে কাতারের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ১৫ বছর এবং ওমানের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ১০ বছরের চুক্তি রয়েছে পেট্রোবাংলার। চলতি অর্থবছরে কাতার থেকে ৪০টি এলএনজি কার্গো আসার কথা, যার মধ্যে এপ্রিল পর্যন্ত ৩৪টি কার্গো ইতিমধ্যে দেশে পৌঁছেছে। কাতারের সরবরাহকারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। এ পর্যন্ত সরবরাহে কোনো সমস্যা হয়নি। তবে হরমুজ প্রণালির সম্ভাব্য সংকট ভবিষ্যতের সরবরাহব্যবস্থায় বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বিপণন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে আন্তর্জাতিক বাজারে যেভাবে জ্বালানির দাম বাড়ছে, এতে হরমুজ প্রণালি বন্ধ না হলেও আগামী মাস থেকে বাংলাদেশে তেলের দাম লিটারে ৪-৫ টাকা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জ্বালানি সরবরাহের এই পথটি বন্ধ হলে বাংলাদেশসহ আমদানিনির্ভর অনেক দেশ জ্বালানির সংকটে পড়বে।
বিপিসি চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান বলেন, ‘ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। আমাদের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য মানতে হয়। প্রতি মাসে তেলের মূল্যের গড় করে মূল্য নির্ধারণ করে থাকি। আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে মনিটরিং করছি।’
বিপিসি চেয়ারম্যান আরও বলেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে জ্বালানি আমদানির বিকল্প পথ হিসেবে লোহিত সাগর ও আরব সাগরকে বেছে নিতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে পরিবহন খরচ (জাহাজ ভাড়া) বেড়ে যাবে।
দেশের কয়েকটি সমুদ্রগামী জাহাজ কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তেলসংকটের পাশাপাশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাঁচামাল ও এলএনজি সংকটের কারণে দেশীয় বাজারে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফারোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল আলম সুজন বলেন, ‘যদি ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়, আশপাশের সমুদ্রসীমানা অরক্ষিত হয়ে পড়বে। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে জাহাজ ঘুরপথে বিকল্প রুটে আসতে হবে। এতে স্বাভাবিকভাবেই পণ্য জ্বালানি পরিবহনে সময় ও ব্যয় দুটোই বেড়ে যাবে। যদিও লোহিত সাগর রুটও ঝুঁকিমুক্ত নয়। কারণ, বিগত সময়ে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের লোহিত সাগরে হামলার কারণে এই রুটও বন্ধ থাকার ঘটনা ঘটেছে। তখন একমাত্র ভরসা আরব সাগর।
দেশের অন্যতম শিল্পোদ্যোক্তা বিএসআরএম গ্রুপের ডিএমডি তপন সেন গুপ্ত বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে প্রায় এক বছর ধরে শিল্প খাত স্থবির হয়ে আছে। এর মধ্যে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত দীর্ঘায়িত হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের শিল্প খাত। কারণ বাংলাদেশের শিল্প খাতের জ্বালানির সিংহভাগই আমদানিনির্ভর। তাই জ্বালানির দাম বাড়লে কিংবা জ্বালানির সংকট হলে দেশের পুরো অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে।
এদিকে ইরান ও ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে জ্বালানির আন্তর্জাতিক বাজারে। এক দিনের ব্যবধানে অপরিশোধিত তেলের দাম ১২ শতাংশ বেড়ে ব্যারেলপ্রতি প্রায় ৭৮.৫ ডলারে পৌঁছেছে। চলমান উত্তেজনা দীর্ঘস্থায়ী হলে তেলের দাম ১০০ থেকে ১৩০ ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা।