আসাদুজ্জামানের বাসায় বৈঠক হতো চেইন অব কমান্ড ভেঙে


চাকরির মেয়াদ শেষে দ্বিতীয়বারের মতো পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হতে অনাগ্রহ দেখিয়েছিলেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এই অনাগ্রহের কথা তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবকেও জানিয়েছিলেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক হতো চেইন অব কমান্ড ভেঙে। দায়িত্বে অবহেলা করার কারণেই তিনি দোষ স্বীকার করেছেন।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ গতকাল বৃহস্পতিবার জেরায় এসব কথা বলেন চৌধুরী মামুন। জেরা শেষে আবার দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেন, সালমান এফ রহমান তাঁকে ফোন করে আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দিতে বিলম্বের কারণ জানতে চেয়েছিলেন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সারা দেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পলাতক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন সাবেক এই আইজিপিকে জেরা করেন। তিনি গত মঙ্গলবার এই মামলায় রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন। সেদিন তাঁকে আংশিক জেরা করা হয়। গতকাল জেরা শেষে পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী সোমবার দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান ও চৌধুরী মামুনকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছে।
চৌধুরী মামুনকে কারাগার থেকে গতকাল ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাঁকে জেরা শুরু হয়। মাঝে এক ঘণ্টার বিরতি দিয়ে বিকেল প্রায় ৫টা পর্যন্ত চলে। এ সময় তাঁকে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এম এইচ তামিম। তাঁর আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদও ছিলেন।
জেরায় চৌধুরী মামুন বলেন, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অবদান রাখা পুলিশ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন পদক দেওয়া হয়। তিনিও পদক পেয়েছিলেন। পরে বলেন, পদক ২০১৮ সালের নির্বাচনের কারণে কি না, তা এ মুহূর্তে বলতে পারছেন না। ‘পুলিশে এত অন্যায়-অনিয়মের পরও পদত্যাগের তাড়না তৈরি হয়নি? কারণ আপনি সুবিধাভোগী’—আইনজীবীর এ কথার জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি পদত্যাগ করিনি। তবে সুবিধাভোগী ছিলাম না।’
সাবেক আইজিপি মামুন বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (সাবেক) আসাদুজ্জামান খান কামালের ধানমন্ডির বাসায় বৈঠকে তিনি থাকতেন না। তাঁকে ওই বৈঠক সম্পর্কে জানানো হতো না। কারণ এসব বৈঠক ছিল অনানুষ্ঠানিক। চেইন অব কমান্ড ভেঙে এসব বৈঠক হতো। অধস্তন যাঁরা বৈঠকে যেতেন তাঁদের নিষেধ করলেও শুনতেন না। তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। কারণ, আসাদুজ্জামান খানের নেতৃত্বে এসব বৈঠক হতো।
জেরার জবাবে চৌধুরী মামুন বলেন, ‘আমি দায়িত্বে অবহেলা করেছি। এ কারণেই দোষ স্বীকার করেছি। সরকারের কোনো অবৈধ নির্দেশনা মানতে পুলিশ বাধ্য না। র্যাবের ডিজি থাকাকালে বন্দিশালাসহ নানা অনিয়মের ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নিইনি।’ আন্দোলন দমনের বিষয়ে তিনি বলেন, পুলিশ আক্রান্ত হলে আক্রান্তের মাত্রা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে, এর বেশি নয়। কোনো আন্দোলন দমন বা নিয়ন্ত্রণ বৈধ সরকারের দায়িত্ব। তবে কোনো শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের গুলি করে হত্যা করা বৈধ নয়। এটা সত্য নয় যে তিনি অযোগ্য পুলিশপ্রধান ছিলেন।
সাবেক এই আইজিপি বলেন, ছাত্রদের আন্দোলন বৈধ ছিল। এরপরও সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের বিরোধিতা করতে হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল হেলিকপ্টার, ড্রোন বা লেথাল উইপন (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহার করার নির্দেশ দেননি, এটা সত্য নয়। তবে এসব ব্যবহারের কোনো লিখিত নির্দেশ পাননি। তিনি জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত অপরাধের অংশীদার বলে স্বীকার করেন।
জেরা শেষে দেওয়া জবানবন্দিতে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ নিহত হওয়ার পর তাঁর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান তাঁকে ফোন করেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বিলম্বের কারণ জানতে চান। রংপুরের পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁকে (মামুন) জানানো হয়, যথাযথ কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদন দিতে বিলম্ব করছে।
জেরা শেষে ট্রাইব্যুনাল থেকে বের হয়ে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন বলেন, ওই দুজন কোনো অপরাধ করেননি। তিনি বলেন, ‘চৌধুরী মামুন ক্ষমা চেয়েছেন। তবে ক্ষমা চাইলেই সবকিছুর ক্ষমা হয় না বলে আমি জানিয়েছি। অনেক কিছুর ক্ষমা হয়, কিন্তু হত্যা মামলার কোনো ক্ষমা হয় না। তিনি যদি হত্যা করেই থাকেন, স্বীকার করেই থাকেন, তাহলে তাঁরও বিচার হওয়া উচিত।’
ক্রাইম জোন ২৪