এপস্টেইন ফাইল কী, এটি নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা কেন


এপস্টেইন ফাইল হলো কুখ্যাত যৌন নিপীড়ক ও নারী পাচারকারী জেফরি এপস্টেইন–সম্পর্কিত নথি, প্রমাণ ও আদালতের রেকর্ডের একটি বিশাল সংগ্রহ। ২০১৯ সালে কারাগারে মৃত্যুর (আত্মহত্যা) পর থেকে এই ফাইলগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে নিয়ে ব্যাপক এবং বিতর্ক তৈরি হয়।
এপস্টেইন ফাইল সম্পর্কিত বিষয়টি প্রকাশের পরেই এর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এমন বেশ কয়েকজন হাই প্রোফাইল ব্যক্তিত্বের নাম সামনে এসেছে। এপস্টেইন-সংক্রান্ত একটি মামলার নথি থেকে জানা গেছে, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ আরও অনেকেই এই তালিকায় আছেন।
বিখ্যাত সাময়িকী ফোর্বসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্যাতনের শিকার ভার্জিনিয়া জিওফ্রে ও এপস্টেইনের সাবেক প্রেমিকা ঘিসলাইন ম্যাক্সওয়েলের মধ্যে একটি মানহানি মামলার ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত সমঝোতার অংশ হিসেবে এই মামলার নথি প্রথম সামনে আসে। সেখান থেকেই কিছু নাম প্রকাশ করা হয়েছিল।
ফোর্বসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই নথিতে অন্তত ১৫০ জনের নাম রয়েছে, যাঁরা বিভিন্নভাবে জেফরি এপস্টেইনের সঙ্গে জড়িত। এই জড়িতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ব্রিটিশ রাজপরিবার থেকে বিতাড়িত প্রিন্স অ্যান্ড্রু, ছাড়াও এই তালিকায় যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হলেন পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসন। এ ছাড়া বিখ্যাত মার্কিন জাদুগর ডেভিড কপারফিল্ড, মার্কিন বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান হাইব্রিজ ক্যাপিটালের সহপ্রতিষ্ঠাতা গ্লেন ডুবিন, নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর বিল রিচার্ডসন, আইনজীবী অ্যালান ডারশোভিৎজ এবং চেইন হোটেল হায়াতের চেয়ারম্যান ও ধনকুবের থমাস প্রিজকার উল্লেখযোগ্য।
ফাইলগুলোতে কী আছে?
মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডির বক্তব্য অনুসারে, ফেডারেল সরকারের কাছে এপস্টেইনের ফৌজদারি মামলা সম্পর্কিত ‘এক ট্রাক বোঝাই’ নথি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— তাঁর ব্যক্তিগত বিমানের ফ্লাইট লগ এবং যোগাযোগের তালিকা। এটি তাঁর ‘ব্ল্যাক বুক’ হিসাবেও পরিচিত, যা ইতিমধ্যেই অনলাইনে পোস্ট করা হয়েছে।
কিছু ছবি ও ভিডিও— এর মধ্যে এপস্টেইন এবং তাঁর নির্যাতনের শিকারদের (যাদের মধ্যে কিছু নাবালক) ছবি এবং ভিডিও রয়েছে, পাশাপাশি ‘অবৈধ শিশু যৌন নির্যাতনের উপকরণ এবং অন্যান্য পর্নোগ্রাফি’-এর ১০ হাজারের বেশি ডাউনলোড করা ভিডিও এবং ছবি রয়েছে।
এই ফাইলগুলিতে পূর্বে ‘জন ডো’ (পরিচয়হীন কোনো পুরুষ) হিসাবে তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের নামও রয়েছে, যা ২০২৪ সালের প্রথম দিকে প্রকাশ করা হয়েছিল। জুলাই মাসে বিচার বিভাগ প্রকাশিত একটি মেমো অনুসারে, তারা এপস্টেইন-সম্পর্কিত তথ্য খুঁজে পেতে তাদের ডেটাবেস, হার্ড ড্রাইভ এবং বাসাবাড়ি তল্লাশি করে ‘৩০০ গিগাবাইটেরও বেশি ডেটা এবং প্রমাণ’ খুঁজে পেয়েছে।
‘ক্লায়েন্ট তালিকা’ কি আছে?
এপস্টেইন ফাইলের সবচেয়ে বিতর্কিত ও আলোচিত বিষয় ছিল ‘ক্লায়েন্ট লিস্ট’। অর্থাৎ কারা এপস্টেইনের কাছে যেতেন বা তাঁর কাছ থেকে নানান সুবিধা নিয়েছেন এমন ব্যক্তির একটি তালিকা। তবে বিচার বিভাগ তাদের মেমোতে স্পষ্ট করে বলেছেন, এপস্টেইন ফাইলে ‘ক্লায়েন্ট তালিকা’ বলে কোনো কিছু ছিল না। মেমোতে বলা হয়েছে, ‘এপস্টেইন তাঁর কার্যকলাপের অংশ হিসেবে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ব্ল্যাকমেল করেছিলেন এমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অনুল্লিখিত তৃতীয় পক্ষের বিরুদ্ধে তদন্তের ভিত্তি তৈরি করতে পারে এমন কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি।’
তদন্তকারী সাংবাদিক জুলি কে ব্রাউন বছরের পর বছর ধরে এপস্টেইন মামলার বিষয়ে অনুসন্ধান করছেন। তিনি এই বছরের শুরুতে বলেছিলেন, ‘জেফরি এপস্টেইনের কোনো ক্লায়েন্ট তালিকা নেই। এটা ইন্টারনেটের কল্পনার ফল— এবং মানুষের বদনাম করার একটি উপায় মাত্র।’ তিনি এটিকে ‘রেড হেরিং’ বা বিভ্রান্তিকর তথ্য বলে অভিহিত করেছেন, যা এপস্টেইনের বান্ধবী ঘিসলাইন ম্যাক্সওয়েল সংকলিত একটি ফোন ডিরেক্টরি (‘ব্ল্যাক বুক’ নামে পরিচিত) থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে হয়। এই ডিরেক্টরিতে ট্রাম্প এবং অন্যান্য সেলিব্রিটিদের নামের সঙ্গে এপস্টেইনের মালি, নাপিত এবং অন্যদের নামও ছিল।
ফাইলগুলো কি প্রকাশ করা হবে?
এটি একটি জটিল প্রশ্ন এবং বর্তমানে এটি নিয়ে রাজনৈতিক বিভেদ চলছে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প ‘এপস্টেইন ফাইল’ প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন বলে মনে হচ্ছে, যা তাঁর উগ্র ডানপন্থী মিত্রদের ক্ষুব্ধ করেছে।
এদিকে জুলাইয়ের শুরুতে মার্কিন বিচার বিভাগ ঘোষণা করেছে, তারা আর নথি প্রকাশ করবে না। তারা যুক্তি দিয়েছে, এতে কিছু মানুষের ক্ষতি হতে পারে এবং ‘ক্লায়েন্ট তালিকা’ বলে কিছু নেই।
চলতি সপ্তাহে, ডেমোক্র্যাটদের সাহায্যে প্রতিনিধি পরিষদের ওভারসাইট সাবকমিটি বিচার বিভাগকে এপস্টেইন-সম্পর্কিত নথি প্রকাশ করার জন্য চাপ দিয়েছিল। তবে হাউস রিপাবলিকান পার্টির নেতারা নথি প্রকাশের এই চেষ্টাও আটকে দিয়েছেন। এ ছাড়া, এপস্টেইন সম্পর্কিত কিছু নথি আদালতের আদেশে সিলগালা করা হয়েছে।
বিচার বিভাগ জানিয়েছে, এপস্টেইনের কারণে এক হাজারের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাদের মধ্যে কিছু নাবালকও আছেন। এদের সংবেদনশীল তথ্য নথিপত্র জুড়ে জড়িত, যার মধ্যে তাদের নাম, শারীরিক বিবরণ, জন্মস্থান এবং কর্মসংস্থানের ইতিহাসও রয়েছে। এই তথ্য প্রকাশ করলে তাদের আরও ট্রমা হতে পারে।
ফাইলগুলো কী কী প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে
এই ফাইলগুলো এপস্টেইন এবং তাঁর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের ওপর আলোকপাত করতে পারে। যেমন— এপস্টেইন কীভাবে এত অর্থ উপার্জন করলেন? কীভাবে তিনি তাঁর ব্যাপক যৌন-পাচার অভিযানকে অর্থায়ন করলেন?
এপস্টেইন গোয়েন্দা এজেন্ট ছিলেন কিনা সে বিষয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যদিও বারবার এই দাবি করা হয়েছে, তবে এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এপস্টেইনের মৃত্যু নিয়েও এখনো সন্দেহ রয়েছে। বিচার বিভাগ তাঁর মৃত্যুর আগে এবং পরের ১১ ঘণ্টার জেলের ফুটেজ প্রকাশ করেছে। তবে এতে তিন মিনিটের ফুটেজ
নেই, যা আরও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কীভাবে এপস্টেইন এত দীর্ঘ সময় ধরে বিচার এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন সে বিষয়েও অনেক কিছু অনুসন্ধান করার আছে।
সামগ্রিকভাবে, এপস্টেইন ফাইলগুলি একটি জটিল এবং সংবেদনশীল বিষয়, যা আইনি, রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে। নথি গুলির সম্পূর্ণ প্রকাশ বর্তমানে অনিশ্চিত এবং এটি বিভিন্ন পক্ষের স্বার্থ ও উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তথ্যসূত্র: দা গার্ডিয়ান