শিরোনাম
পুলিশের দাবি ঘটনাটি রাজনৈতিক নয়, পারিবারিকএনবিআর আন্দোলনের ৬ নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামছে দুদককুয়াকাটায় ‘অতিরিক্ত মদ্যপানে’ কিশোর পর্যটকের মৃত্যুওয়াজিরিস্তানে সেনাবহরে আত্মঘাতী হামলায় নিহত ১৩, ভারতকে দায়ী করল পাকিস্তানহিমাগার ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ, ভাড়া কমানোর নির্দেশবেসরকারি আর্থিকপ্রতিষ্ঠানে চাকরি, কর্মস্থল ঢাকাভারতে রথযাত্রায় পদপিষ্ট হয়ে ২ নারী ও এক বৃদ্ধের মৃত্যু, আহত ৫০মতলব উত্তরে পরীক্ষার্থীদের পাশে ছেংগারচর ছাত্রদলদোহারে পরীক্ষার্থীদের সহায়তায় ছাত্রশিবিরের হেল্প ডেস্কআশাব্যঞ্জক অগ্রগতির ক্ষেত্রে আমরা খানিকটা পিছিয়ে আছি: আলী রীয়াজ

বিমানবন্দরের প্রকল্পে ‘অসম’ চুক্তি, স্বার্থের সংঘাতে জড়িয়েছেন ঢাকায় ইউএই রাষ্ট্রদূত

বিমানবন্দরের প্রকল্পে ‘অসম’ চুক্তি, স্বার্থের সংঘাতে জড়িয়েছেন ঢাকায় ইউএই রাষ্ট্রদূত

বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোতে উন্নত যাত্রী তথ্য ব্যবস্থা স্থাপনের একটি প্রকল্পে বিগত সরকারের অসম চুক্তির তথ্য উঠে এসেছে। শুধু তা-ই নয়, স্পর্শকাতর এই প্রকল্পে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) রাষ্ট্রদূতের ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

আরব আমিরাতের একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিকে এই প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হলেও, চুক্তির একটি বড় অংশ সাব-কন্ট্রাক্ট করা হয়েছে এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে, যার অংশীদার স্বয়ং বাংলাদেশে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত আবদুল্লাহ আলী আলহমুদি।

গতকাল শনিবার যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই-এর প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশের সরকারকে আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অনেক বেশি মাসুল দিতে হবে। এতে যাত্রীদের ওপরও অতিরিক্ত ব্যয় চাপিয়ে দেওয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই ঘটনায় রাষ্ট্রদূতের কূটনৈতিক পদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক স্বার্থের সংঘাতের গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে যখন তিনি দুই দেশের বিমান চলাচল খাতের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এই চুক্তিটি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি এর পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।

ড. ইফতেখারুজ্জামান এটিকে ‘স্বার্থের সংঘাত এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি স্পষ্ট উদাহরণ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি মিডল ইস্ট আইকে বলেন, ‘একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে, একজন রাষ্ট্রদূত সরকারের নির্দিষ্ট অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রমে জড়িত হতে পারেন না। প্রথম প্রশ্ন হলো, এই ধরনের অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল কিনা। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, তিনি যে মূলধন বিনিয়োগ করেছেন, তার উৎস কী?’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘একজন কর্মরত সরকারি কর্মকর্তার সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকতে পারে না। এটি কেবল নৈতিকতা নয়, কূটনৈতিক শিষ্টাচারেরও লঙ্ঘন।’

এ বিষয়ে মিডল ইস্ট আই রাষ্ট্রদূত আলহমুদি, ঢাকায় আরব আমিরাতের দূতাবাস, আমিরাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকার এবং জড়িত কোম্পানিগুলোর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত কোনো পক্ষই মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

চুক্তির বিষয়ে অবগত বাংলাদেশের কর্মকর্তারাও মুখ খুলতে চাননি, কারণ তাঁদের আশঙ্কা, এ বিষয়ে কথা বললে দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব পড়তে পারে।

মিডল ইস্ট আই-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকার একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোতে অ্যাডভান্স পেসেঞ্জার ইনফরমেশন (এপিআই) এবং পেসেঞ্জার নেম রেকর্ড (পিএনআর) ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য এ চুক্তি হয়। এই কাজের জন্য আমিরাতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা এমিরেটস টেকনোলজি সলিউশনসকে (Etek) নিয়োগ করা হয়। এই সংস্থার প্রধান কার্যালয় ফুজাইরাহতে অবস্থিত।

কিন্তু Etek এই কাজটির একটি বড় অংশ আইডেন্টিমা (Identima) নামের একটি দুবাই-ভিত্তিক কোম্পানিকে সাব-কন্ট্রাক্ট হিসেবে দেয়। আইডেন্টিমা কোম্পানিটি ২০২১ সালে রাষ্ট্রদূত আলহমুদি নিজে নিবন্ধন করেন। নথিপত্র অনুযায়ী, আলহমুদি এই কোম্পানিতে ৩৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক এবং এর ম্যানেজার হিসেবেও তালিকাভুক্ত। বাকি ৬৬ শতাংশ শেয়ারের মালিকানায় রয়েছেন দুই বাংলাদেশি নাগরিক মুনতাসির বিল্লাহ শাহরিয়ার এবং সাজেদ আহমেদ সামির।

শাহরিয়ার সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে মিডল ইস্ট আই-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর বৈঠকের ছবিও সংগ্রহ করেছে মিডল ইস্ট আই।

এ ছাড়া Etek বা Identima, কোনো প্রতিষ্ঠানেরই বিমানবন্দর তথ্য ব্যবস্থা স্থাপন বা পরিচালনার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই।

আইডেন্টিমা এরপর সুইজারল্যান্ডের একটি কোম্পানি সিটা (SITA)-এর সঙ্গে চুক্তি করে। এই কোম্পানি এই খাতের বিশ্বসেরা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অন্যতম এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিমানবন্দরগুলোতেও তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।

নথি অনুযায়ী, এই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে যাত্রীপ্রতি জন্য প্রায় ৬ দশমিক ৫০ চার্জ করা হচ্ছিল। অবশ্য পরবর্তীতে তা ৪ ডলারে কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইসিএও) এই ধরনের সেবার জন্য যাত্রীপ্রতি জন্য ৩ দশমিক ৫০ ডলার চার্জের সুপারিশ করে। সিটা সংযুক্ত আরব আমিরাতেই একই সেবার জন্য যাত্রীপ্রতি ১ দশমিক ৫০ ডলার চার্জ নেয়।

এই উচ্চ মূল্য নিয়ে সিএএবি-এর (বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ—বেবিচক) একজন কর্মকর্তা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কারণ এর ফলে অতিরিক্ত বোঝা বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকসহ সাধারণ যাত্রীদের ওপর চাপানো হতে পারে।

এদিকে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে কূটনীতিকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণে প্রণীত ভিয়েনা কনভেনশন, কূটনীতিকদের যে দেশে তাঁরা কর্মরত, সেখানে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড থেকে লাভবান হওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে। আলহমুদি ২০২২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পান, আর এর তিন মাস পরেই বিমানবন্দরের প্রকল্পটি নিয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

২০২১ সালের অক্টোবরে Etek এবং Identima-এর মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা স্মারকে উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো পক্ষই স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি করবে না। এই নথিতে সাক্ষী হিসেবে আলহমুদির স্বাক্ষর রয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকটির মেয়াদ চলতি মাসের শেষ নাগাদ শেষ হওয়ার কথা। আমিরাতের দূতাবাস গত ২২ মে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে ২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এর মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছে।

তবে, বেবিচকের পক্ষ থেকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ‘ধীরগতি’র কথা জানানো হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিলে একটি ইংরেজি দৈনিক এই খবর প্রকাশ করে। এরপর বিভিন্ন দেশের প্রস্তাব পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করে বেবিচক। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রদূত আলহমুদির ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসায় পুরো প্রকল্পের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button