সমীক্ষা-সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই ২০ হাজার কোটির দুই প্রকল্প


স্বাস্থ্যের দুটি বড় প্রকল্প; বাস্তবায়ন কাল ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৯ সালের জুন। বিস্তারিত প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুযায়ী, মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ১৯ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। এত বড় প্রকল্প গ্রহণের আগে চালানো হয়নি কোনো প্রকার সমীক্ষা, এমনকি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই পর্যন্ত করা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, প্রকল্পের জন্য কত জনবল নিয়োগ দিতে হবে এবং কতগুলো গাড়ি কিনতে হবে, সে বিষয়েও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নেওয়ার কাজ পর্যন্ত করা হয়নি। এ ধরনের অনেক অসংগতি রেখেই তড়িঘড়ি প্রকল্প নিয়ে তা পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটিতে (পিইসি)। এ অবস্থায় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি আলাদা বৈঠক করে প্রকল্প দুটি ফেরত পাঠিয়েছে, বলেছে সব শর্ত পূরণের মাধ্যমে নতুন করে ডিপিপি করতে।
সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই নেওয়া প্রকল্প দুটির একটির নাম ‘হেলথ অ্যান্ড নিউট্রেশন সার্ভিসেস ইমপ্রুভমেন্ট অ্যান্ড সিস্টেম স্ট্রেংদেনিং প্রকল্প’। এই প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ১৫ হাজার ১২৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৮ হাজার ৬৬৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা আর বৈদেশিক ঋণ থেকে আসবে ৬ হাজার ৪৫৯ কোটি ৫১৩ লাখ টাকা।
অপর প্রকল্পটির নাম, ‘ক্লাইমেন্ট রেসপনসিভ রিপ্রোডাকটিভ অ্যান্ড পপুলেশন সার্ভিসেস ইমপ্রুভমেন্ট অ্যান্ড সিস্টেম স্ট্রেংদেনিং প্রজেক্ট ফর রেজাল্ট’। ডিপিপিতে প্রকল্পটির ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৪৬৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকার অর্থায়ন করবে ৩ হাজার ৩৩৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা আর বৈদেশিক অর্থায়ন ১ হাজার ৩৫১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। প্রকল্প দুটি নিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, প্রকল্প দুটির ডিপিপিতে পরতে পরতে রয়েছে নানা ঘাটতি ও অসংগতি। উভয় প্রকল্পেই ব্যয়ের বড় একটি অংশ বৈদেশিক সহায়তা থেকে আসার কথা বলা হলেও বৈদেশিক অর্থায়নের বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে দাতা সংস্থার চুক্তির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই প্রকল্পে। মূলত বিদেশি অর্থায়ন লুফে নেওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে প্রকল্প পাস করাতে গিয়ে ব্যয়-বিবরণ, কাঠামো ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনায় বিশাল ফাঁকফোকর রেখে দিয়েছে প্রকল্প প্রস্তুতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। পিইসি বৈঠকে এসব নানা অসংগতি ধরা পড়ায় প্রকল্প দুটির বিষয়ে আলোচনার পর পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ওষুধ-সরঞ্জাম কেনার তালিকা ও বাজারদর নির্ধারণে মার্কেট কমিটির প্রতিবেদন, বার্ষিক রাজস্ব বাজেটে ধাপে ধাপে ব্যয় অন্তর্ভুক্তির রূপরেখা দেওয়া এবং ভবন নির্মাণের জন্য আলাদা প্রকল্প নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া পরামর্শক খাতে খরচের যৌক্তিকতা দেখাতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রধান মো. আব্দুর রউফ (অতিরিক্ত সচিব) বলেন, চলতি বছরের আরএডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। প্রকল্পটির কোনো সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়নি, জনবল নিয়োগ এবং যানবাহন ক্রয়ের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের অনুমোদন গ্রহণ করা হয়নি। তাই সব ধরনের কাগজপত্রে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রসহ প্রকল্প দুটি সংশোধন করে আবার জমা দিতে হবে।
ব্লক বরাদ্দই ৭৫ শতাংশ
হেলথ অ্যান্ড নিউট্রেশন সার্ভিসেস ইমপ্রুভমেন্ট অ্যান্ড সিস্টেম স্ট্রেংদেনিং প্রকল্পের ৫৪টি উপাদানের মধ্যে ৪৫টিই ব্লক বরাদ্দ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মোট বাজেটের ৭৫ শতাংশ অর্থাৎ ১১ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা কী খাতে খরচ হবে, তার নির্দিষ্ট তালিকা নেই। ওষুধ, ভ্যাকসিন, সার্জিক্যাল সামগ্রী কেনার জন্য ৬ হাজার ২১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও কোনটাতে কত খরচ, নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি।
ভবন নির্মাণ, পরামর্শক নিয়োগেও অসংগতি
দুই প্রকল্পে ভবন নির্মাণের জন্য ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে মোট ৩ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। কিন্তু প্রকল্পের মূল কাঠামোয় ভবন নির্মাণ নেই। পিইসি বৈঠকে বলা হয়, ভবন নির্মাণের কাজ আলাদা অবকাঠামো প্রকল্প হিসেবে নিতে হবে, যেন একই প্রকল্পে পুনরাবৃত্তি না হয়। পরামর্শক খাতে ২৬১ কোটি টাকার প্রস্তাব থাকলেও কতজন পরামর্শক নিয়োগ হবে, তাঁদের কাজ কী, পারিশ্রমিক কত—এসব কিছুই পরিষ্কার নয়। কমিশন বলছে, পরামর্শকদের কাজের ধরন ও পরিমাণ অনুযায়ী টার্মস অব রেফারেন্স (টিওআর) ও বাজেট দিতে হবে।
চুক্তি ছাড়াই তড়িঘড়ি
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, জুন মাসের মধ্যে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত না হলে ৪০৪ মিলিয়ন ডলারের বিদেশি সহায়তা হাতছাড়া হবে। এ কারণে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে চিঠি দিয়ে প্রকল্পগুলো দ্রুত একনেকে তোলার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ইআরডি এখনো দাতা সংস্থাগুলোর চুক্তি বা প্রতিশ্রুতিপত্র জমা দেয়নি। এমনকি জনবল নিয়োগ, গাড়ি কেনাসহ বেশ কিছু খাতে অর্থ বিভাগের অনুমোদনও নেওয়া হয়নি।
নীতি পরিবর্তনে খণ্ড খণ্ড প্রকল্পের ঝুঁকি
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বছর থেকে সেক্টরভিত্তিক কর্মসূচি বাদ দিয়ে প্রকল্পভিত্তিক বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে চলতি মেয়াদে (২০২৪-২০২৯) ৫ম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত উন্নয়ন কর্মসূচি বাতিল করে আলাদা আলাদা প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এতে সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সংহতি ও সমন্বয় বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতের এমন প্রকল্প বাস্তবায়নে তাড়াহুড়ো নয়, বরং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিকে প্রাধান্য দিতে হবে। প্রকল্পগুলোতে স্বচ্ছতা, ব্যয় যৌক্তিকতা ও পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। তাঁরা বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই না করে এমন বড় প্রকল্প তড়িঘড়ি অনুমোদনের চেষ্টা করলে উন্নয়ন সহযোগীদের আস্থায় আঘাত লাগতে পারে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিগত সময়ে প্রকল্পের নামে লোপাট হয়েছে। এই লোপাটের কারণে দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি নেই। প্রকল্প নেওয়ার আগেই তার প্রয়োজনীয়তা এবং খরচের যৌক্তিকতা তুলে ধরেই প্রকল্পে প্রস্তাব করতে হয়। প্রকল্প নির্বাচনের আগে প্রকল্পের সমীক্ষা ও সম্ভাব্যতা শেষ করতে হবে।
নাম না প্রকাশের শর্তে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক কর্মকর্তা বলেন, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করে ব্যয়ের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে হবে। ব্লক বরাদ্দ বাদ দিয়ে পণ্য, সেবা, অবকাঠামোর নির্দিষ্ট ধরন, পরিমাণ ও খরচ বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করতে হবে। পরামর্শক খাতের জন্য টিওআর ও ব্যয়ের পূর্ণ বিবরণ দিতে হবে। প্রকল্পের ‘এক্সিট প্ল্যান’-এ ভবিষ্যতে পরিচালন ব্যয়ে অন্তর্ভুক্তির পরিকল্পনা থাকতে হবে। প্রকল্প সমন্বয়ের অভাব দূর করতে মন্ত্রণালয়কে সমন্বিত কার্যপরিকল্পনা সাজানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্প দুটির বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. আফরিনা মাহমুদ বলেন, প্রকল্পের বিষয়ে সুস্পষ্ট কর্মপন্থা ও কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন।