প্রতিটি গুমের ঘটনার বিচার হওয়া প্রয়োজন


প্রতিটি গুমের ঘটনার বিচার হওয়া প্রয়োজন বলে অভিমত দিয়েছেন সফররত জাতিসংঘের গুম বা নিখোঁজবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের (ডব্লিউজিআইডি) সদস্য আনা লোরেনা ডেলগাদিলো পেরেজ। গতকাল বুধবার বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির কার্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘অ্যাড্রেসিং এনফোর্সড ডিজএপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য আনা লোরেনা পেরেজ বলেন, ‘সরকার যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খুব কম সময়ে তারা দেখিয়েছে দেশের চিত্র (গুম প্রতিরোধের বিষয়ে) পরিবর্তনে তাদের সম্মতি রয়েছে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো তাদের হারিয়ে যাওয়া সদস্যদের ফিরে পেতে চায়। একই সঙ্গে তারা বিচারও চায়। এই পরিবারগুলোর কথা শুনতে হবে। প্রতিটি ঘটনার বিচার হওয়া প্রয়োজন।’
গুম প্রতিরোধে অন্তর্বর্তী সরকারের তিনটি পদক্ষেপ ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেন ব্লিউজিআইডির ভাইস চেয়ারপারসন গ্রাজিনা বারানোস্কা। তিনি বলেন, ‘আমরা ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছিলাম। এখানে আসার আগেই আমরা দেখেছি যে, তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। প্রথমটি হলো, খুব দ্রুত গুমবিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে বাংলাদেশের স্বাক্ষর করা, যেটা এ বিষয়ে সরকারের প্রতিশ্রুতিকে বোঝায়। দ্বিতীয়ত, তদন্ত কমিশন (গুমবিষয়ক) গঠন করা। আর তৃতীয়টি হলো, আমরা শুনেছি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গুম নিয়ে একটি আইন প্রণয়নের কাজ চলছে। এটা খুবই ইতিবাচক পদক্ষেপ।’
গ্রাজিনা বারানোস্কা অবশ্য এ-ও বলেন, ‘ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও কিছু সংকট রয়ে গেছে। গুমের শিকার ব্যক্তি এবং ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা অতীতে হয়রানির শিকার হতেন, এখনো তাঁদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। ভুক্তভোগীদের জন্য একটি সেন্টার থাকা প্রয়োজন, যেখানে তাদের কথা শোনা হবে এবং যেখান থেকে সব ধরনের সহযোগিতা মিলবে।’
সভায় সেনাবাহিনী এবং পুলিশের সদস্যরা তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেন। সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরা বলেন, সেনাবাহিনী নয়, বরং অন্য কিছু সংস্থা গুমের সঙ্গে জড়িত ছিল।
ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের ফ্যাকাল্টি মেম্বার মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে গুমে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তবে এর সঙ্গে সেনাবাহিনী জড়িত নয়। সেনাসদস্যরা র্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআই, বিজিবিসহ অন্য সংস্থায় ডেপুটেশনে থাকা অবস্থায় তাঁদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলো এসেছে।
সেনাবাহিনীর আরেকজন প্রতিনিধি বলেন, বেশির ভাগ গুমের অভিযোগ র্যাব এবং ডিজিএফআইয়ের বিরুদ্ধে। র্যাব হলো পুলিশের একটি সংস্থা। আর ডিজিএফআই হলো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা, যেখানে সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীর সদস্য এবং বেসামরিক লোকও নিয়োগ হয়। যদি ডিজিএফআইয়ের বিষয়ে অভিযোগ থাকে বা ডিজিএফআই কিছু করে থাকে, তার মানে এটা নয় যে, সেটা সেনাবাহিনী করেছে।
সভায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক সদস্য এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুম বলেন, বিগত শাসনামলে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া বা গুম রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হওয়া অস্ত্রগুলোর একটি ছিল। ঢাকার ঘটনাগুলো উঠে এলেও, ঢাকা থেকে দূরে বা তৃণমূলের ঘটনাগুলো মানুষের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। তাবাসসুম উল্লেখ করেন, আন্দোলন চলার সময় তাঁকেও ছয় দিনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাঁর গ্রামে বিএনপির একজন তৃণমূলপর্যায়ের নেতা ও তাঁর বামপন্থী রাজনীতি করা ছোট ভাইকে ১২ বছর গুম করে রাখা হয়েছিল।
সভায় গুমের শিকার ব্যক্তিরা তাঁদের ওপর চলা নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন। আলোচনায় আরও অংশ নেন সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসিফ ইকবাল, পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ সুপার শারমিন আক্তার, নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক তাসনিম খলিল, এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা প্রমুখ।