গাজীপুরে স্কুলের মাঠে কুটির শিল্প মেলা, লটারির নামে চলছে রমরমা জুয়া


গাজীপুর মহানগরীর গাছায় স্কুলের মাঠে আয়োজিত গ্রামীণ কুটির শিল্প পণ্য মেলায় লটারির নামে রমরমা জুয়া চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, শিল্প-কারখানার খেটে খাওয়া শ্রমিক—সবাই চটকদার পুরস্কারের লোভে লটারির অসংখ্য টিকিট কিনছেন। মেলার নামে দেদারসে লটারির টিকিট বেচে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন আয়োজকেরা।
গাছা থানার অধীন গাছা উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে চলছে মাসব্যাপী এ কুটির মেলা। জানা গেছে, বাংলাদেশ বেনারসি মসলিন অ্যান্ড জামদানি সোসাইটির
সভাপতি এম এ মাঈন খান ওরফে বাবুল গাজীপুর মহানগর পুলিশের অনুমতি নিয়ে মাসব্যাপী মেলার আয়োজন করেছেন।
আজ সোমবার (১ সেপ্টম্বর) সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, গাছা উচ্চবিদ্যালয়ের ১৯৮ শতাংশ আয়তনের খেলার মাঠে গ্রামীণ কুটির শিল্প পণ্য মেলা চলছে। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অনেক শিক্ষার্থী মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেলার জন্য মাঠের সীমানাপ্রাচীর ভেঙে বসানো হয়েছে ১০-১২টি কাউন্টার।
গত ৮ আগস্ট শুরু হওয়া এ মেলায় কুটির শিল্পের তেমন কোনো পণ্যই নেই। কুটির পণ্যের বদলে মেলায় রয়েছে মিষ্টির দোকান, কয়েকটি ফুচকার স্টল, নাগরদোলা, স্লিপার, ওয়াটার বোট, লটারির টিকিট বিক্রি ও ড্র সেন্টার।
মূলত, মেলাপ্রাঙ্গণে ঢোকার জন্য ২০ টাকায় টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। সে টিকিটেই হচ্ছে লটারি। লটারি বেচতে মহানগরীর কয়েকটি থানা এলাকাজুড়ে চালানো হচ্ছে চটকদার প্রচারণা। বিক্রি করা হচ্ছে প্রবেশমূল্যের লটারির টিকিট। অনেকে মেলায় না গিয়েও ১০-২০টি, কেউ কেউ শতাধিক টিকিট
কিনে লটারিতে অংশ নিচ্ছেন। লটারিতে গরু, মোটরসাইকেল, স্বর্ণালংকার, ইজিবাইকসহ ৪০ থেকে ৪৫টি পুরস্কার দেওয়া হয় প্রতিরাতে। কিন্তু পুরস্কার পান মাত্র ৪০-৪৫ জন। অন্যদের টাকা যায় জলে। এভাবেই আয়োজকেরা প্রতিদিন হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, মেলার আকর্ষণীয় পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, রিকশাচালকসহ নিম্ন আয়ের মানুষদের টার্গেট করে চালানো হয় প্রচারণা। অনেকে আকর্ষণীয় পুরস্কারের আশায় সারা দিনের আয়, কেউ কেউ মাসের বেতনের টাকা দিয়ে টিকিট কিনে লটারি পাওয়ার বাজি ধরেন।
মেলার টিকিট কাউন্টারে থাকা যুবক মো. আশরাফুল বলেন, বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে টিকিট বিক্রির জন্য তাঁদের দেড় শ অটোরিকশা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এত দিন মেলার সামনে মূল ফটকে ব্যানার দেওয়া ছিল। সেখানে লেখা ছিল, ‘জিএমপির অনুমতি ও সার্বিক সহযোগিতায়’ এ মেলার আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু গতকাল রোববার রাতে সেটি খুলে ফেলা হয়েছে। কেন খুলে ফেলা হয়েছে, সেটি তাঁর জানা নেই।
মেলার কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুলের মাঠে খেলতে বা অ্যাসেম্বলি করতে পারছে না। বরং অনেকে মেলায় অকারণে ঘুরে বেড়াতে ক্লাস ফাঁকি দিচ্ছে। গাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাসনারা সিদ্দিকা বলেন, ‘ওই মাঠে আমাদের ছাত্রছাত্রীদেরও অ্যাসেম্বিল হতো। মেলার জন্য আমরা এখন সকালের অ্যাসেম্বলি করতে পারি না। স্কুলের বারান্দায় শিশুদের অ্যাসেম্বলি করতে হচ্ছে। মাঠের চারপাশে টিনের বেড়া দেওয়ায় আমাদের স্কুলের দক্ষিণ পাশ দিয়ে আলো-বাতাস আসতে পারে না। মেলার টয়লেট আমাদের স্কুলের কাছে স্থাপন করায় দুর্গন্ধে ক্লাসে থাকা যায় না।’
গাছা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমার মেলার অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা নেই। মেলার আয়োজকেরা আমার কাছে এলে আমি লিখিত দিয়ে বলেছি, যথাযথ কর্তৃপক্ষ মেলার অনুমতি দিলে আমার আপত্তি নেই। পরে দেখি, জিএমপি থেকে মেলার অনুমতি দিয়েছে। পুলিশ অনুমতি দিয়েছে, এখানে আমার কী করার আছে? আমরা জেলা প্রশাসনের কাছে গিয়েছি। পরে দেখি, জিএমপি থেকে আবার জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, মহানগরীতে মেলার অনুমতি দেওয়ার এখতিয়ার জিএমপি কমিশনারের আছে। এসব কারণে আমরা চুপ করে আছি।’
এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য মেলার অফিসে মেলা আয়োজকদের কাউকে পাওয়া যায়নি। অফিসে গিয়ে মেলা আয়োজক উপকমিটির আহ্বায়কের নম্বর পাওয়া যায়। তাঁকে ফোন দিলে খায়রুল কন্ট্রাক্টর নামের একজন ফোন রিসিভ করে বলেন, ‘আমি মালিকের সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানাচ্ছি।’ কিন্তু পরে তাঁকে কয়েকবার ফোনকল দিলেও তিনি আর রিসিভ করেননি।
গাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, মেলাটি এক মাসের জন্য হবে। যার অনুমোদন কমিশনার দিয়েছেন। চলতি মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত চলবে। গাজীপুর জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফীন বলেন, ‘মেলার জন্য আমরা কাউকে অনুমোদন দিইনি। পরে পুলিশ নিজেই মেলা করার অনুমোদন দেয়। বিষয়টি গতকাল (রোববার) কোর কমিটিতেও আলোচনা হয়েছে।’ এ বিষয়ে জিএমপি কমিশনার ড. নাজমুল করিম খানের বক্তব্য নিতে মোবাইল ফোনে কল দিলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
ক্রাইম জোন ২৪