চোখের নিচে কালি, ক্লান্ত দেখানোই এখন টিকটকে বিউটি ট্রেন্ড


বর্তমান প্রজন্মের সাজসজ্জায় এসেছে এক অভিনব পরিবর্তন। চোখের নিচে কালো দাগ, ফ্যাকাশে মুখ আর ঠোঁটে হালকা বেগুনি রং মিলিয়ে একধরনের ক্লান্ত ও অবসন্ন মেকআপ লুক এখন টিকটকে খুবই জনপ্রিয়। এত দিন চেহারার যেসব ক্লান্তির চিহ্ন লুকানোর চেষ্টা করা হতো, এখন সেটাই ‘টায়ার্ড গার্ল’ নামের নতুন ট্রেন্ড।
সাজসজ্জায় বা মেকআপের মাধ্যমে যতটা সম্ভব চেহারায় ক্লান্তির ছাপ লুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে বহু বছর ধরেই। কনসিলার, আই ক্রিম ও কারেক্টর স্টিকের মতো প্রসাধনী মূলত আমাদের সতেজ দেখানোর জন্যই তৈরি। ঐতিহাসিকভাবে ক্লান্ত চেহারা মানে ধরা হয়েছে অসুস্থতা ও বার্ধক্যের প্রতীক হিসেবে। তবে টায়ার্ড গার্ল বিউটি ট্রেন্ড সেই ধারণার ঠিক উল্টো—এটি সেই ত্রুটিগুলোকেই আলিঙ্গন করে, যেগুলো আমরা এত দিন লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি।
এই নতুন ট্রেন্ডের সূচনা করেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী জেনা ওর্তেগা। নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় ‘ওয়েডনেসডে’ সিরিজে অ্যাডামস পরিবারের মেয়ের অভিনয়ে এ ধরনের মেকআপ করেন তিনি।
নতুন মৌসুমের প্রিমিয়ারে লন্ডনের রেড কার্পেটেও তিনি এই সাজ বজায় রাখেন—হালকা স্মাজড আইশ্যাডো, ফ্যাকাশে গাল আর প্রাকৃতিকভাবে চোখের নিচে কালো দাগ।
ট্রেন্ডটি মূলত জেনারেশন জেডদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লেও আগের প্রজন্মের দর্শকদের জন্য এটি নতুন কিছু নয়। অনেকেই স্মরণ করবেন বিখ্যাত সিনেমা ‘গার্ল, ইনটারাপটেড’-এ অ্যাঞ্জেলিনা জোলির সাজকে অথবা ‘লিওন: দ্য প্রোফেশনাল’-এ নাটালি পোর্টম্যানকে। তাঁদের সেই সময়ের মেকআপ স্টাইলের সঙ্গে এই নতুন ট্রেন্ডের বেশ মিল রয়েছে।
বর্তমানে এই মেকআপ লুক অনুসরণ করছেন—জনি ডেপের মেয়ে লিলি রোজ ডেপ, মডেল ও সংগীতশিল্পী গ্যাব্রিয়েট, ইনফ্লুয়েন্সার এমা চেম্বারলেইন, ড্যানিয়েল মারকান এবং লারা ভায়োলেটা। টিকটকে এখন ‘#tiredgirlmakeup’ নামে হাজার হাজার ভিডিও তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ভিডিও ৩ লাখেরও বেশি ভিউ পেয়েছে।
এদিকে টায়ার্ড গার্ল ট্রেন্ডের অন্যতম জনপ্রিয় মুখ লারা ভায়োলেট। তিনি বলেন, চোখের নিচের কালো দাগ খুবই স্টাইলিশ, কারণ এগুলোর জন্য সত্যিকারের পরিশ্রম করতে হয়।’ অবশ্য তিনি নিজের বিশেষ মেকআপ স্টাইলকে ‘মোল্ডি মেকআপ’ হিসেবে পরিচিতি দিতে পছন্দ করেন।
‘টায়ার্গ গার্ল’ লুককে গথ (goth) বা গ্রাঞ্জ (grunge) বলে ভুল করা যাবে না। গথ সংস্কৃতি যেমন সংগীত ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এসেছে, গ্রাঞ্জ আবার ৯০ দশকের কর্টনি লাভের মতো শিল্পীদের ফ্যাশনের মাধ্যমে। তবে টায়ার্ড গার্ল ট্রেন্ডটি অনেকটাই দ্রুত পরিবর্তনশীল।
ট্রেন্ড গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘দ্য ফিউচার ল্যাব্রেটরি’ উপসম্পাদক ড্যান হেস্টিংস-নারায়ানিন বলেন, এটি মূলত ‘কোর’ সংস্কৃতির একটি অংশ যেমন—‘কটেজকোর’ (প্রাকৃতিক ও রোমান্টিক) কিংবা ‘বার্বিকোর’ (প্রাণবন্ত ও অতিনারীবাদী)। এগুলো ব্যক্তি বা মেজাজকে মুহূর্তেই তুলে ধরতে সাহায্য করে, তবে দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
ওয়েডনেসডে সিরিজে এই সাজ তৈরির নেপথ্যে ছিলেন মেকআপ আর্টিস্ট তারা ম্যাকডোনাল্ড। তিনি জানান, ওর্তেগার ত্বকের চেয়ে আরও বেশি ফ্যাকাশে রঙের ফাউন্ডেশন ব্যবহার করা হয় এবং চোখের নিচের কালো দাগ গোপন না করেই তাকে একটি ‘প্রাকৃতিক অথচ স্মার্ট’ সাজ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ঠোঁটের রং এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়, যেন ঠোঁটটি সদ্য কামড়ে লাল হয়ে গেছে।
ওয়েডনেসডের সিজন টু-র মেকআপ ডিজাইনার নিরভানা জালালভান্দ জানান, ‘ওয়েডনেসডে এমন এক মেয়ে নন যে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজের সাজগোজে ব্যয় করবে। তাঁর সামনে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব রয়েছে।’ এই সাজ মূলত প্রচলিত ‘ক্লিন গার্ল’ ট্রেন্ডের বিপরীতে—যেখানে মসৃণ ত্বক, গোলাপি গাল ও হালকা চোখের মেকআপ থাকে।
জালালভান্দ বলেন, ‘এটি শুধু মেকআপ নয়, এটি একটি সংস্কৃতির প্রতিফলন। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও এখন আর অতিরিক্ত নিখুঁত ছবি পোস্ট নয়—বরং ঘোলাটে, এলোমেলো ছবির মাধ্যমেই নিজেকে প্রকাশ করছে তরুণেরা। টায়ার্ড গার্ল সেই পরিবর্তনেরই বহিঃপ্রকাশ।’
ম্যাকডোনাল্ড বলেন, ‘এই মেকআপ যে কেউ করতে পারেন। এখানে নিখুঁত হ্যান্ড বা দামি ব্রাশের দরকার নেই।’
ড্যান হেস্টিংস-নারায়ানিন মনে করেন, জেন–জেডদের এই ক্লান্তির ট্রেন্ড বাস্তব জীবনের চাপের প্রতিফলন—চাকরি, পড়াশোনা, ঋণ, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে উদ্বেগসহ নানা কিছুর সঙ্গে লড়াই করছে তারা। তাই এই ক্লান্তির প্রকাশ একরকম মানসিক লড়াইয়ের প্রকাশও বটে।
তিনি বলেন, ‘এই সাজ যেন এক হাস্যরসাত্মক প্রতিবাদ—‘হ্যাঁ, আমি ক্লান্ত, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চিত, কিন্তু আমি এই গ্লানি নিয়েই হাসছি।’
তথ্যসূত্র: সিএনএন
ক্রাইম জোন ২৪