ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চল রেখে দিতে কেন মরিয়া রাশিয়া


পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে গঠিত ডনবাস। এই অঞ্চলটি নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সংঘাত তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ডনবাস হারালে তা ইউক্রেনের জন্য ‘বিধ্বংসী পরিণতি’ বয়ে আনতে পারে। এই অঞ্চলটিই শুক্রবার (১৫ আগস্ট) আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠকে আলোচনার অন্যতম মূল বিষয় হতে পারে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কি দাবি করেছেন, পুতিন যুদ্ধবিরতির শর্ত হিসেবে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে দোনেৎস্ক থেকে সরে যেতে বলেছেন। এর অর্থ, পুতিন ডনবাসের অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ অঞ্চলও দখল করতে চান। গত সাড়ে তিন বছর এখানেই সবচেয়ে ভয়াবহ লড়াই সংঘটিত হয়েছে। দোনেৎস্ক দখলে নিতে পারলে কার্যত পুরো ডনবাসের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যাবে রাশিয়া।
ডনবাস নামটি এসেছে ‘দোনেৎস বেসিন’ থেকে। এটি মূলত কয়লা সমৃদ্ধ একটি বিশাল এলাকা। ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্ত জুড়ে বিস্তৃত এই এলাকাটি দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক ওবলাস্ট নিয়ে গঠিত। ২০১৪ সাল থেকেই এই অঞ্চলটির কিছু অংশ আংশিকভাবে রুশ দখলে ছিল। সেই বছর রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপও দখল করে নিয়েছিল।
বর্তমানে রাশিয়া দাবি করে—ক্রিমিয়া, সেভাস্তোপল, লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন তাদের অংশ। তবে ইউক্রেন ও জাতিসংঘ এগুলোকে রুশ ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না।
রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ডনবাসের প্রায় ৮৮ শতাংশ দখলে নিয়েছে রাশিয়া। এর মধ্যে রয়েছে লুহানস্কের পুরো অংশ এবং দোনেৎস্কের ৭৫ শতাংশ অঞ্চল। তবে ইউক্রেন এখনো ডনবাসের প্রায় ৬ হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ধরে রেখেছে, যার মধ্যে পোকরোভস্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরও রয়েছে। রুশ বাহিনী তাই এখন দোনেৎস্ক ফ্রন্টে সবচেয়ে বেশি চাপ দিচ্ছে।
ডনবাস অঞ্চলটি মূলত ইউক্রেনের কয়লা খনি ও ধাতুবিদ্যার কেন্দ্র। ২০১৪ সালে রাশিয়ার সঙ্গে বিবাদ শুরুর পরই ইউক্রেনের কয়লা উৎপাদন ২২.৪ শতাংশ কমে যায়। এ থেকেই বোঝা যায়, ডনবাসের কয়লার ওপর ইউক্রেন অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই অঞ্চলটি ইউক্রেনের জ্বালানি নির্ভরতার প্রতীক। অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছাড়াও যুদ্ধক্ষেত্রে ডনবাস যেন একটি একটি ‘দুর্গ বলয়’। দোনেৎস্ক থেকে শুরু হওয়া এই অঞ্চলের প্রতিরক্ষা লাইনের বিস্তৃতি স্লোভিয়ানস্ক, ক্রামাতোর্স্ক, দুরুশকিভকা ও কস্তিয়ানতিনিভকা ছাড়িয়ে গেছে।
সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান পলিসি অ্যানালাইসিসের ফেলো এলিনা বেকেতোভা জানান, ডনবাসে স্থাপন করা হয়েছে বহুস্তরীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। বছরের পর বছর ধরে এখানে গড়ে তোলা হয়েছে বাংকার, অ্যান্টি-ট্যাংক খাদ, মাইনফিল্ড এবং শিল্প এলাকা।
বেকেতোভা সতর্ক করেন—ইউক্রেন এই প্রতিরক্ষা লাইন হারালে রুশ বাহিনী আর মাত্র ৮০ কিলোমিটার পশ্চিমে এগিয়ে গেলেই সমতলভূমি পাবে। ফলে ভবিষ্যতে রুশ বাহিনী সহজেই ইউক্রেনের খারকিভ, পোলতাভা ও দিনিপ্রোর দিকে অগ্রসর হতে পারবে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি অবশ্য স্পষ্ট করেছেন, ইউক্রেন কখনোই ডনবাস ছেড়ে যাবে না। তিনি বলেন, ‘আমরা ডনবাস ছাড়ব না। এটি অবৈধভাবে দখল করা হয়েছে।’
বলা যায়, ডনবাসের নিয়ন্ত্রণ তাই শুধু একটি ভূখণ্ডের লড়াই নয়, বরং ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার জন্য এটি একটি নির্ণায়ক যুদ্ধক্ষেত্র। রাশিয়া এটি দখল করা মানে, অনির্দিষ্টকালের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে যাবে ইউক্রেন, হয়ে যাবে রুশ খেলার পুতুল।
ক্রাইম জোন ২৪