বিকৃত লাশ দুটি ৩০ ঘণ্টা ধরে গাড়িতে, একজনের মুখ ছিল থেঁতলানো


রাজধানীর মৌচাকে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের পার্কিংয়ে একটি প্রাইভেট কার থেকে যে দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তাঁরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক রোগীকে এলাকায় নেওয়ার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন। পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
লাশ উদ্ধার হওয়া জাকির ও মিজান দুজনের বাড়িই নোয়াখালীর চাটখিলে। দুজনের মধ্যে জাকির গাড়িচালক ছিলেন।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজনের মধ্যে একজনের মরদেহ গাড়ির চালকের আসনে ও অন্যজনের মরদেহ পেছনে যাত্রীর আসনে পাওয়া গেছে। দুটি লাশই বিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। যাত্রীর আসনে থাকা মরদেহের মুখ থেঁতলানো অবস্থায় ছিল। গাড়ির সব দরজা খোলা ছিল। তাঁদের মৃত্যুর কারণ নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জানায়নি পুলিশ।
মৃত্যুর রহস্য নিয়ে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মাসুদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, ৩০ থেকে ৩২ ঘণ্টা লাশ দুটো ওই গাড়ির ভেতরে ছিল। এ কারণে লাশ দুটি অন্য রকম হয়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে বলার কিছু নেই। ময়নাতদন্তে চিকিৎসকেরা হয়তো বুঝতে পারবেন—অন্য কোনো ঝামেলা রয়েছে কি না। খালি চোখে বোঝা সম্ভব নয়। অনেক জিজ্ঞাসা রয়েছে। একটু সময় লাগবে। তদন্তে যদি অস্বাভাবিক কিছু থাকে, আসবে।
পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গতকাল রোববার (১০ আগস্ট) ভোর ৫টা ৩২ মিনিটে হাসপাতালের রিসিপশনে আসেন গাড়ির মালিক সৌরভ ও তাঁর সঙ্গে ছিলেন মিজান। আর গাড়ির চালক জাকির চলে যান বেজমেন্টের দিকে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য। রিসিপশনে সৌরভ ও মিজান কথা বলা শেষে মিজান চলে যান গাড়ির কাছে আর সৌরভ চলে যান নোয়াখালী। সৌরভ অন্য একটি কাজে ঢাকায় এসেছিলেন। জাকির ও মিজান হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন জোবায়ের নামের এক রোগীকে নিয়ে নোয়াখালী যাবেন বলে আসেন।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিশু জোবায়েরের বাবা হুমায়ুন কবির আজকের পত্রিকাকে জানান, গত ২২ জুলাই হাসপাতালটিতে ছেলে জোবায়েরকে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করান। তাঁর বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলায়। গতকাল রোববার জোবায়েরকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিতে পারে বলে এলাকার মনির নামের একজনের সঙ্গে গাড়ি ভাড়া করার বিষয়ে কথা বলেন তিনি। মনির তাঁকে জাকির নামের একজনের গাড়ি ভাড়া করার কথা জানান।
তিনি বলেন, ‘জাকির বিমানবন্দরে ভাড়া নিয়ে আসবে বলে জানান মনির। যাওয়ার সময় আমাদের নিয়ে যাবেন। তখন আমি মনিরকে বলেছি, আমাদের রিলিজ দিলে আসতে বলবেন। গাড়ির লোকজনের সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি।’ তবে নিহত দুজনের বাড়ি তাঁর এলাকায় বলে জানান হুমায়ুন। আর আজও তাঁরা হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাননি বলে জানান।
পুলিশ জানায়, তাঁরা গাড়ি নিয়ে ভোরে আসায় মনে হয় ওই সময় রোগীর লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। তাঁরা হয়তো চিন্তা করেছেন, একটু অপেক্ষা করে কথা বলবেন। নিচে নেটওয়ার্কের ঝামেলা থাকায় মালিকও কয়েকবার চেষ্টা করে তাঁদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে পারেননি।
আজ বিকেলে হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায়, বেজমেন্টের মুখে প্রায় অর্ধশত মানুষ ভিড় করছেন। গণমাধ্যমকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। লাশের সুরতহাল করছে রমনা থানা-পুলিশ। আর যে প্রাইভেট কারটিতে লাশ দুটি পাওয়া গেছে, গাড়িটির নম্বর হলো—ঢাকা মেট্রো গ ৩৬-৩৭৪৫।
বেজমেন্টটিতে ঢোকার মুখে সিসিটিভি ক্যামেরা দেখা গেছে। বেজমেন্টের ভেতরও সিসি ক্যামেরা রয়েছে। তবে ওই গাড়ি যেখানে পার্ক করা ছিল, ওই স্থান সিসি ক্যামার আওতায় পড়েনি।
সেখানে হাসপাতালটির সিকিউরিটি ইনচার্জ মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আজ বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে পার্কিংয়ে জায়গা খালি রয়েছে কি না দেখার জন্য বেজমেন্টের তৃতীয় তলায় আসি। এসে দেখি, গাড়ির ভেতরে দুজন আছেন। বাইরে থেকে কয়েকবার ডাকাডাকি করলেও সাড়া না পেয়ে দরজা খুলি। খুলে দেখি, দুজনেই মারা গেছেন। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা পুলিশে খবর দেয়।’
ঘটনার দিন আজ সকালে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেজমেন্টের তৃতীয় তলায় সিকিউরিটির দায়িত্বে ছিলেন সুবাস বড়ুয়া। আজ বিকেলে তিনি বলেন, ‘ভোর ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে গাড়িটি বেজমেন্টে প্রবেশ করে। হাসপাতালে রোগী রয়েছে বলে জানান গাড়ির চালক। তবে কোনো রোগীর নাম বলেননি গাড়ির চালক। পরে তাঁর গাড়ির নম্বর লিখে নিই।’
তিনি আরও বলেন, যাঁরা রোগী নিয়ে আসেন, তাঁরা কখনো ৪-৫ ঘণ্টা, কখনো সকালে এসে বিকেলে রোগী নিয়ে চলে যান। যখন কোনো গাড়ি ১২ ঘণ্টা বা ২৪ ঘণ্টা হওয়ার পরও বের না হয়, তখন গাড়িগুলো চেক করা হয়। ওই প্রাইভেট কারটি যখন ঢোকে, তখন গাড়িতে শুধু চালক ছিলেন।
সকাল ৮টা পর্যন্ত ডিউটিতে ছিলেন সুবাস। এরপর ডিউটিতে আসেন সিকিউরিটি ইনচার্জ মিজানুর রহমান। এ সময় তিনি গাড়ির হিসাব দিয়ে যান মিজানুর রহমানকে।
হাসপাতালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালমান আহমেদ বলেন, ‘হাসপাতালটিতে নোয়াখালী এলাকা থেকে অনেক রোগী আসে। গাড়ির ওই চালক প্রায়ই রোগী নিয়ে আসেন। ঘটনার দিনও তারা রোগী নিতে আসছিল শুনেছি। কিন্তু কীভাবে মারা গেল, তা জানা যায়নি।’
ঘটনার বিষয়ে হাসপাতালের উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. আব্দুল মালেক মৃধা বলেন, ‘ঘটনাটা হাসপাতালের পার্কিংয়ের বেজমেন্টে। আমরা কিছুই জানি না। নিরাপত্তাকর্মীরা লাশ দেখে জানানোর পর আমরা পুলিশে খবর দিই। পরে তারা লাশ নিয়ে যায়।’
উপপুলিশ কমিশনার মাসুদ আলম বলেন, গাড়ির মালিক সৌরভ নোয়াখালী থেকে ঢাকায় এসেছেন। ঘটনার বিষয়ে আরও জেনে ও ময়নাতদন্তের পর মামলার বিষয়ে প্রক্রিয়া শুরু হবে।
ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে সিআইডি। লাশের সুরতহাল করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ক্রাইম জোন ২৪