পশ্চিমাদের প্রস্থানে ইরাকের তেল বাণিজ্যে আধিপত্য বাড়ছে চীনা কোম্পানির


বিশ্বের প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন ওপেকের দ্বিতীয় বৃহত্তম সদস্য ইরাক। সম্প্রতি ইরাকে নিজেদের কার্যক্রম বাড়াতে শুরু করেছে চীনের স্বশাসিত তুলনামূলক ছোট ও বেসরকারি তেল কোম্পানিগুলো। যেখানে আন্তর্জাতিক বড় বড় তেল কোম্পানিগুলো ধীরে ধীরে ইরাক থেকে নিজেদের কার্যক্রম কমিয়ে আনছে, সেখানে বিপরীত পথে হাঁটছে চীনের এই কোম্পানিগুলো।
চীনের এই কোম্পানিগুলো এরই মধ্যে ইরাকে কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এই খাতে কাজ করা চারটি কোম্পানির কর্মকর্তাদের থেকে জানা যায়, তারা ইরাকে দৈনিক উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ করে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ লাখ ব্যারেলে উন্নীত করার লক্ষ্যে এগোচ্ছে।
বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করতে লড়াই করতে থাকা ইরাকের জন্য এ বিষয়টি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে দেশটির তেল উৎপাদন খাতে চীনের বেসরকারি খাতের ক্রমাগত জায়গা করে নেওয়া উদ্বেগের সৃষ্টি করেছিল। ইরাকের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা চীনের ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন এবং অনেক ক্ষেত্রে এটি ঠেকানোর চেষ্টাও করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও, ইরাকের তেল খাতে স্বশাসিত চীনা কোম্পানিগুলোর আধিপত্য স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল জায়ান্টগুলো থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করা কর্মকর্তাদের নিয়ে পরিচালিত ছোট ছোট চীনা তেল কোম্পানিগুলোর কাছে ইরাক এখন একটি বড় সুযোগ। পশ্চিমা বা বড় চীনা কোম্পানির জন্য যেসব প্রকল্প তুলনামূলকভাবে ছোট ও কম লাভজনক, সেগুলোতে কম খরচে এবং দ্রুতগতিতে উন্নয়ন ঘটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তারা।
চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত তেল ও গ্যাস খাতে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ কম থাকায় এই বিদেশমুখী উদ্যোগ অন্য ভারী শিল্প খাতের মতোই চীনা কোম্পানিগুলোর জন্য নতুন বাজার ও দক্ষতা ব্যবহারের ক্ষেত্র তৈরি করছে।
জিও-জাদে পেট্রোলিয়াম কর্প, ইউনাইটেড এনার্জি গ্রুপ, ঝংমান পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস গ্রুপ ও অ্যান্টন অয়েলফিল্ড সার্ভিসেস গ্রুপের মতো তুলনামূলকভাবে অখ্যাত কোম্পানিগুলো গত বছর ইরাকের তেল অনুসন্ধানের সুযোগ পেয়ে সবার নজরে আসে।
এই কোম্পানিগুলোর নির্বাহীরা জানান, ইরাকে বিনিয়োগের পরিবেশ আগের চেয়ে তুলনায় অনেক উন্নত হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ছে। পাশাপাশি দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থায় বাগদাদ এখন একইসঙ্গে চীনা ও পশ্চিমা উভয় ধরনের কোম্পানিকে আকৃষ্ট করতে আগ্রহী।
২০২৯ সালের মধ্যে তেল উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ শতাংশেরও বেশি বাড়িয়ে দৈনিক ৬০ লাখ ব্যারেলে নিয়ে যেতে চায় ইরাক। বর্তমানে দেশটির উৎপাদনের বড় একটি অংশই আসে চীনের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (সিএনপিসি) পরিচালিত হাইফায়া, রুমাইলা ও ওয়েস্ট কুর্না ১-এর মতো বিশাল তেলক্ষেত্রগুলো থেকে।
এক বছর আগে তেল প্রকল্পের জন্য আগের নির্ধারিত ফি ভিত্তিক চুক্তি থেকে সরে আসে ইরাক। এ সময় লাভ ভাগাভাগি নির্ভর মডেল চালু করে দেশটির সরকার। এক্সনমোবিল ও শেলের মতো পশ্চিমা তেল জায়ান্টদের কার্যক্রম সীমিত হওয়ার পর প্রকল্পে গতি আনার লক্ষ্যে নেওয়া এই পদক্ষেপ চীনের স্বশাসিত বেসরকারি তেল কোম্পানিগুলোর জন্য এক বড় সুযোগ তৈরি করে দেয়।
এই ছোট চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো বড় চীনা কোম্পানির তুলনায় অনেক বেশি চটপটে ও অভিযোজনযোগ্য। আবার পশ্চিমা অনেক বিনিয়োগকারীর তুলনায় তারা ঝুঁকি নিতে অনেক বেশি আগ্রহী।
ইরাকের রাষ্ট্রীয় বসরা অয়েল কোম্পানির কর্মকর্তা আলি আব্দুলআমির জানান, চীনা কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতামূলক অর্থায়ন প্রস্তাব করে, তুলনামূলক সস্তা চীনা শ্রমিক ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে খরচ কমায় এবং দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি পেতে কম লাভেও কাজ করতে রাজি থাকে।
তিনি আরও বলেন, ‘চীনা কোম্পানিরা দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষ, সময়সীমা মেনে চলে এবং নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জপূর্ণ এলাকাতেও কাজ করতে প্রস্তুত থাকে। পশ্চিমা কোম্পানির তুলনায় তাদের সঙ্গে কাজ করা অনেক সহজ ও কম জটিল।’
চীনা কোম্পানিগুলো নির্বাহীরা জানান, পশ্চিমা কোম্পানির যেখানে একটি তেলক্ষেত্র উন্নয়নে ৫ থেকে ১০ বছর সময় লাগে, সেখানে চীনের ছোট কোম্পানিগুলো ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যেই কাজ শেষ করতে পারে।
জিও-জাদে পেট্রোলিয়াম-এর প্রধান নির্বাহী (সিইও) ডাই শিয়াওপিং বলেন, ‘চীনের স্বশাসিত কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনাগত খরচ পশ্চিমা কোম্পানির তুলনায় অনেক কম এবং তারা রাষ্ট্রায়ত্ত চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও প্রতিযোগিতায় এগিয়ে।’
তিনি আরও জানান, এই কোম্পানিগুলোর কারণে ইরাকে একটি বড় তেলক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক একটি কূপ খননের গড় খরচ গত এক দশকে অর্ধেকে নেমে এসেছে। এখন তা প্রায় ৪ থেকে ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে।
ইরাকের জন্য এই চীনা কোম্পানির সাশ্রয়ী প্রকল্পগুলো অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হলেও উচ্চমানের প্রযুক্তি ও দক্ষতার উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছু আপস করতে হচ্ছে বলে আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন ইরাকি বিশেষজ্ঞরা।
চলতি বছরের মে মাসে চীনা কোম্পানি জিও-জেডের নেতৃত্বাধীন একটি কনসোর্টিয়াম দক্ষিণ বসরার টুবা তেলক্ষেত্রের উন্নয়ন ও একটি ২ লাখ ব্যারেল দৈনিক ক্ষমতাসম্পন্ন রিফাইনারি নির্মাণে বিনিয়োগের চুক্তি করে। জিও-জেড কোম্পানির সিইও ডাই শিয়াওপিং জানান, প্রায় ৮৪৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে ২০২৭ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে অচল থাকা টুবা ক্ষেত্রের উৎপাদন ৪০ হাজার ব্যারেল দৈনিক করা হবে।
এই প্রকল্পের আওতায় একটি পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স ও দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রও নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে, যার জন্য বহু বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে বলে জানান ডাই।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছোট চীনা প্রতিষ্ঠান ঝেনহুয়া অয়েল ২০০৮ সালে সিএনপিসির সঙ্গে যৌথভাবে ৩ বিলিয়ন ডলারের আহদাব তেলক্ষেত্র উন্নয়নে অংশ নেয়। ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর ওই প্রকল্পটি ছিল ইরাকে প্রথম বড় বিদেশি বিনিয়োগ। এখন ঝেনহুয়া ২০৩০ সালের মধ্যে এর উৎপাদন দ্বিগুণ করে ২ লাখ ৫০ হাজার ব্যারেল দৈনিক করার লক্ষ্য নিয়েছে।
চীনা কোম্পানি ঝংমান পেট্রোলিয়াম চলতি বছরের জুনে ঘোষণা দেয়, ২০২৪ সালে পাওয়া মধ্য ইউফ্রেটিস ও পূর্ব বাগদাদ উত্তর ব্লকের উন্নয়নে তারা ৪৮১ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে।
তবে, এই সাশ্রয়ী প্রকল্পগুলোর একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো এতে ইরাকের উচ্চতর প্রযুক্তি সংযোজন ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাধা তৈরি হতে পারে। বসরা অয়েলের সাবেক অপরিশোধিত তেল বিভাগের প্রধান মুওয়াফাক আব্বাস বলেন, ‘চীনা কোম্পানিগুলোর স্বচ্ছতা ও কারিগরি মান নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। তারা প্রায়ই চীনা কর্মীদের ওপর নির্ভর করে এবং ইরাকি কর্মীদের নিম্ন বেতনের পদে সীমাবদ্ধ রাখে।’
তবে কিছু পশ্চিমা কোম্পানি আবার ইরাকে ফিরছে। ২০২৩ সালে ফরাসি কোম্পানি টোটালএনার্জি ২৭ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প ঘোষণা করেছে। আর ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান বিপি কিরকুকের আধা-স্বায়ত্তশাসিত কুর্দি অঞ্চলে চারটি তেলক্ষেত্র পুনর্গঠনে ২৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।