শিরোনাম

মুদিদোকান থেকে বিশ্বমঞ্চে যে দুটি প্রতিষ্ঠান

মুদিদোকান থেকে বিশ্বমঞ্চে যে দুটি প্রতিষ্ঠান

‘ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল,/গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল…’ —লাইনগুলো আমরা বহুবার শুনেছি জীবনে। যেসব মানুষ এ লাইনগুলোর মর্মার্থ জীবনে প্রয়োগ করেছে, তারা ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। সেই সব মানুষের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান, যারা আক্ষরিক অর্থেই বিন্দু বিন্দু করে সিন্ধু তৈরি করে এখন বিশ্বমঞ্চ দখল করে নিয়েছে। তেমনি দুটি প্রতিষ্ঠান আলডি ও স্যামসাং।

আক্ষরিক অর্থে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়েছিল পাড়ার মোড়ের একতলা মুদিদোকানের মতো জায়গা থেকে। আলডি ও স্যামসাং দুটি ভিন্ন মহাদেশের প্রতিষ্ঠান। আলডি ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানির একটি ছোট দোকান। আর স্যামসাং ছিল কোরিয়ার নুডলস ও শুকনা মাছ বিক্রয়কারী ছোট আরেকটি দোকান। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা নিজেদের শ্রম ও মেধা দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।

স্যামসাং

স্যামসাংয়ের ইতিহাসটা আসলে মাছ বিক্রেতা থেকে টেক জায়ান্ট হয়ে ওঠার গল্প।

দক্ষিণ কোরিয়ার সিওল শহরের স্যামসাং টাউনে স্যামসাং-এর সদর দপ্তর। ছবি: উইকিপিডিয়া
দক্ষিণ কোরিয়ার সিওল শহরের স্যামসাং টাউনে স্যামসাং-এর সদর দপ্তর। ছবি: উইকিপিডিয়া

১৯৩৮ সালের ১ মার্চ। সে সময়কার তেগু আর বর্তমান দক্ষিণ কোরিয়ার দেগু শহরে লি বিউং-চুল ‘স্যামসাং স্যাংগু’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। মূলধন মাত্র ৩০ হাজার ওন অর্থাৎ দক্ষিণ কোরিয়ার মুদ্রা আর কর্মচারী প্রায় ৪০ জন। স্যামসাং শব্দের অর্থ তিনটি তারা। প্রতিষ্ঠানটির পণ্য কি ছিল জানেন? ছিল শুকনা মাছ, নুডলস আর কিছু মুদি-মনিহারি দ্রব্য। সেই দোকানের চারপাশে থাকত বাইসাইকেল, ভেতরে কাঠের টেবিল আর টালি দেওয়া ছাদ। এমনই ছিল ভবিষ্যতে পৃথিবীময় সাম্রাজ্য তৈরি করা এক প্রতিষ্ঠানের শুরু!

লি ছিলেন স্বপ্নবাজ মানুষ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজের দোকান আরও প্রসারিত করেন। সুতা, চিনি, বিমা, ব্যাংক—যেখানে সুযোগ ছিল, সেখানেই পৌঁছে যায় স্যামসাং। ১৯৬৯ সালে তিনি নিলেন এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। প্রতিষ্ঠা করলেন স্যামসাং ইলেকট্রনিকস। শুরুটা সাদা-কালো টেলিভিশন দিয়ে। এরপর এল ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, ভিডিও রেকর্ডার। বাড়তে বাড়তে সেই তালিকা ২০২৫ সালে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, সেটা বুঝে নিন। স্যামসাং ১৯৭৪ সালে সেমিকন্ডাক্টর ব্যবসায় পা রেখে শুরু করে নিজেদের নতুন অধ্যায়।

১৯৩৮ সালে সে সময়কার তেগু আর বর্তমান দক্ষিণ কোরিয়ার দেগু শহরে লি বিউং-চুল এই ছোট্ট দোকান থেকে শুরু করেছিলেন স্যামসাং নামের প্রতিষ্ঠানটি। ছবি: উইকিপিডিয়া
১৯৩৮ সালে সে সময়কার তেগু আর বর্তমান দক্ষিণ কোরিয়ার দেগু শহরে লি বিউং-চুল এই ছোট্ট দোকান থেকে শুরু করেছিলেন স্যামসাং নামের প্রতিষ্ঠানটি। ছবি: উইকিপিডিয়া

১৯৮৭ সালের ১৯ নভেম্বর মারা যান স্যামসাংয়ের প্রতিষ্ঠাতা লি বিউং-চুল। তত দিনে এটি পৃথিবীময় ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। এরপর প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার হন তাঁর ছেলে লি কুন-হি। লি বিউং-চুলের ছোট মেয়ে লি মিয়ং-হি এখন শিনসেগায়ে গ্রুপের প্রধান।

১৯৯৩ সাল ছিল স্যামসাংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বছর। সে বছর প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট লি কুন-হি ঘোষণা দেন, সব বদলে ফেলবেন তিনি। এই মান উন্নয়ন নীতিতে প্রতিষ্ঠানটি চূড়ান্ত রূপান্তরের পথে পা রাখে। ২০০৯ সালে আসে স্যামসাংয়ের মোবাইল ফোন গ্যালাক্সি সিরিজ। ২০১২ সালে সে সময়কার জায়ান্ট নকিয়াকে টপকে স্যামসাং হয়ে ওঠে বিশ্বের বৃহত্তম স্মার্টফোন নির্মাতা। আজ শুধু মোবাইল ফোন নয়, ঘরের জিনিস থেকে শুরু করে প্রযুক্তি ব্যবসার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে স্যামসাং।

আলডি

মানুষের কম দামে জিনিসপত্র কেনার প্রবণতা আর দুই ভাইয়ের দূরদর্শী চিন্তার গল্প এক সুতায় বাঁধলে পাওয়া যায় আলডির ইতিহাস।

বাঁয়ে আলডি জ্যুড ও ডানে আলডি নর্ড এর লোগো। ছবি: উইকিপিডিয়া
বাঁয়ে আলডি জ্যুড ও ডানে আলডি নর্ড এর লোগো। ছবি: উইকিপিডিয়া

১৯৪৫ সালের কথা। যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানি তখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে ব্যস্ত। এমন সময় কার্ল আলব্রেখট ও থিও আলব্রেখট নামের দুই ভাই তাঁদের মায়ের চালানো ছোট্ট মুদিদোকানটি পরিচালনার ভার নেন। দোকানটি খোলা হতো সকালে, চলত সন্ধ্যা পর্যন্ত। সেই দোকানে দুই ভাই দাঁড়িয়ে থেকে চাহিদা বুঝে গ্রাহকদের হাতে পণ্য তুলে দিতেন।

দুই ভাইয়ের মধ্যে কার্ল ছিলেন বড় আর থিও ছোট। কার্ল ও থিও যথাক্রমে ১৯২০ ও ১৯২২ সালে জন্মেছিলেন। তাঁদের বাবা ছিলেন একজন খনি শ্রমিক। হাঁপানিজনিত অসুস্থতায় বাবার চাকরি চলে গেলে কার্ল ও থিওর মা মুদিদোকান চালু করেন। থিও মায়ের সঙ্গে কাজ করতেন। আর কার্ল অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি সেনাবাহিনীতেও কাজ করেন। ১৯৪৫ সালে তাঁরা তাঁদের মায়ের দোকানের দায়িত্ব নেন নিজেদের কাঁধে এবং পরবর্তী পাঁচ বছরে অর্থাৎ ১৯৫০ সালের মধ্যে তাঁরা ১৩টি দোকানের মালিক হয়ে যান।

এভাবে চলতে চলতে কার্ল ও থিও ভাবলেন, অন্য কী করা যায়। একেবারে নতুন কিছু, যা কেউ করেনি! খাতাকলম নিয়ে বসে গেলেন দুই ভাই। দেখলেন, যদি পণ্যের সংখ্যা সীমিত করা হয় আর বিজ্ঞাপনের পেছনে টাকা ঢালা না হয়, তাহলে দোকানটা একদম সরল আর ছিমছাম করে ফেলা যায়। সেটা করতে পারলে পণ্যের দাম কমানো সম্ভব। তাঁরা বুঝে গেলেন, মানুষ কম দামে পণ্য চায়। তাদের অনেক ধরনের পণ্য না হলেও চলে।

এই ব্যবসায়িক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে জন্ম নিল জার্মান সুপারমার্কেট চেইন আলডি। আলব্রেখট ও ডিসকাউন্ট শব্দটির প্রথম অক্ষর দিয়ে তৈরি করা হলো আলডি নামটি। ছোট শহরের ছোট দোকান থেকে মাত্র ১৫ বছরের মধ্যে জার্মানিতে তাঁদের শাখা হয়ে উঠল ৩০০।

আলডির আসল খেলা শুরু হয় ১৯৬০ সালে। সে বছর আলাদা হয়ে গেলেন কার্ল ও থিও। নিজেদের দোকানে সিগারেট বিক্রি করবেন কি না, সেই বিতর্ক থেকে আলাদা হয়ে যান দুই ভাই। এর পরেই জন্ম নেয় থিওর মালিকানায় আলডি নর্ড আর কার্লের মালিকানায় আলডি জ্যুড। ১৯৬৬ সাল থেকে প্রতিষ্ঠান দুটি আর্থিক ও আইনগতভাবে পৃথক হয়ে যাত্রা শুরু করে। দুটি ভিন্ন প্রতিষ্ঠান হলেও আলডি পৌঁছে যায় বিভিন্ন দেশে। ১৯৬৭ সাল থেকে প্রতিষ্ঠান দুটি আন্তর্জাতিক অধিগ্রহণ শুরু করে।

প্রতিষ্ঠান আলাদা, কিন্তু মূলমন্ত্র একটাই—যা শুরু থেকে ছিল। কার্ল ও থিওর মূলমন্ত্র ছিল, কম ঝামেলায় দরকারি জিনিস যথাসম্ভব কম দামে গ্রাহকদের হাতে তুলে দেওয়া। দ্রুত চেক আউট, প্যাকেজে একাধিক বারকোড, প্যাকেটজাত পণ্য—সব মিলিয়ে আলডি হয়ে উঠেছিল ‘নো‑ফ্রিল’ রেভল্যুশনের ব্র্যান্ড। আর এই দর্শনের জোরেই আজ বিশ্বের নানান দেশে ১২ হাজারের বেশি স্টোর আছে আলডির।

সূত্র: দ্য সান, দ্য গার্ডিয়ান, ইয়াহু টেক, লাভ ফুড



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button