উদ্বোধনের অপেক্ষায় তিস্তা সেতু


গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম সীমান্তে তিস্তা নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে তিস্তা সেতু। নদীর নামের সঙ্গে মিলয়েই এ নামকরণ করা হয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষা সেতুটি উদ্বোধনের।
সেতুটি দিয়ে যান চলাচল শুরু করলেই গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটসহ উত্তরাঞ্চলের যাতায়াত আরও সহজ হবে। এলাকার উৎপাদিত পণ্য সারা দেশে পৌঁছে যাবে অল্প সময়ের মধ্যই। তখনই চরাঞ্চলসহ এলাকার মানুষের ভাগ্যের চাকা খুলে যাবে। আসবে আর্থিক পরিবর্তন। এমন আশা করছেন এই জনপদের বাসিন্দারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে এটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে।
এদিকে যান চলাচল শুরুর আগেই সেতুটি ঘিরে সেখানে তৈরি হয়েছে একধরনের বিনোদনকেন্দ্র। প্রতিদিন শত শত মানুষ ছুটে আসছে সেতু দেখতে।
সেতুটি নির্মিত হয়েছে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুরঘাট এলাকায়। জেলা শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ২৮ কিলোমিটার। এর অপর প্রান্তে কুড়িগ্রামের চিলমারী ঘাট।
গাইবান্ধা এলজিইডি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, তিস্তা নদীর ওপর ১ হাজার ৪৯০ মিটার দীর্ঘ এ সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯২৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর প্রকল্পটির দরপত্র আহ্বান করা হয়। কাজের দায়িত্ব পায় চীনা প্রতিষ্ঠান ‘চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন লিমিটেড’।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নানা বয়সী মানুষ সেতু দেখতে এসেছে। অনেকেই পরিবার নিয়ে সেতুর ওপর হাঁটছিলেন, ছবি তুলছিলেন। শিশুদের জন্য নাগরদোলা বসানো হয়েছে, আশপাশে গড়ে উঠেছে খেলনা ও খাবারের অস্থায়ী দোকান। কেউ নদীর জলে পা ভিজিয়ে নিচ্ছিলেন, কেউ দল বেঁধে গোসল করছিলেন, আবার কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভ করছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, সেতুটি উদ্বোধন হলেই যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হবে। তখন গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম জেলার চরাঞ্চলসহ উত্তরাঞ্চলের কৃষিপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, শিল্পজাত পণ্য সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে স্থানান্তর করা যাবে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায়। পাশাপাশি শিল্প ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার ব্যবসায়ী আইনুল হক বলেন, ‘সেতুটি চালু হলে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে সুবিধা হবে। এক মুল্লুক আর ঘোরা লাগবে না। চরের জিনিসপাতির দাম কৃষকেরা সঠিক পাবে।’
কৃষক তারা মিয়া বলেন, ‘যোগাযোগ ভালো না থাকার কারণে চরের কাঁচামালগুলোর হামরা দাম পাই নাই। এখন দূর থেকে পাইকাররা আসবে। আশা করি জিনিসপাতির দাম থেকে আর বঞ্চিত হবা লই।’
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হরিপুর ইউনিয়নের ছিচা বাজারের বাসিন্দা শামীম মন্ডল বলেন, ‘সেতুটি দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফল। সেতুটি চালু হলে যোগাযোগব্যবস্থার দ্বার খুলে যাবে। সুন্দরগঞ্জ একটি উপজেলা শহর। এখান থেকে দূরপাল্লার কোনো গাড়ি যাতায়াত করে না। সেতুটি চালু হলে অসংখ্য গাড়ি যাতায়াত করবে। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হলেই এলাকার মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটবে।’
রাইসুল কামাল বলেন, ‘আমি কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। বর্ষাকালে নদীতে স্রোত বেশি থাকলে নৌকা চালাতে ভয় লাগে, তাই ঘুরে রংপুর হয়ে যেতে হয়। এতে সময় ও খরচ দুই-ই বাড়ে। সেতু চালু হলে সেই কষ্ট থাকবে না, ঝুঁকিও কমবে।’
সেতু ও সংযোগ সড়ক চালু হলে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকার দূরত্ব ১৩৫ কিলোমিটার কমে আসবে। কেবল কুড়িগ্রাম নয়, উত্তরাঞ্চলের আরও কয়েকটি জেলার ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে। গাইবান্ধার মতো তুলনামূলক পশ্চাৎপদ একটি জেলার আর্থসামাজিক উন্নয়নও ঘটবে।
গাইবান্ধা জেলা দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মাকসুদার রহমান বলেন, ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক থেকে গাইবান্ধা শহর ২১ কিলোমিটার দূরে। এ কারণে এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার হয়নি। তিস্তা সেতু ও সংযোগ সড়ক চালু হলে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলার মানুষ গাইবান্ধা শহরের ভেতর দিয়ে ঢাকায় যাতায়াতের সুযোগ পাবে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব খাতে উন্নয়ন হবে।
গাইবান্ধা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী উজ্জ্বল চৌধুরী বলেন, ‘দেশে এলজিইডির সবচেয়ে বড় প্রকল্প এই তিস্তা সেতু। সেতুটি উন্মুক্ত হলে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকার দূরত্ব কমবে ১৩৫ কিলোমিটার। এতে সময় সাশ্রয় হবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। মূল সেতুর কাজ শেষ। কিছু সংযোগ সড়ক ও বিদ্যুৎ সংযোগের সামান্য কাজ বাকি আছে। সেতু চালুর পর যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হবে, নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে, চরাঞ্চলের কৃষকেরা তাদের ফসলের ন্যায্য দাম পাবে। এ ছাড়া দুই জেলার মানুষের নতুন নতুন কর্মসংস্থান বাড়বে। এতে করে এলাকার মানুষের জীবনমান আরও উন্নত হবে।’